ক্লাব পর্যায়ে এমন কোনো ট্রফি বাকি নেই যেটা জেতেননি। বাকি ছিল শুধু বিশ্বকাপ। কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের ২২তম আসরে আর্জেন্টিনার জার্সিতে সেটাও জিতলেন। আর তাতেই নিজেকে নিয়ে গেছেন সর্বকালের সর্বসেরা ফুটবলারের কাতারে। বলছি আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসির কথা।
জন্ম, জন্মস্থান ও পরিবার
মেসির পৈতৃক নিবাস ছিল ইতালির আকোনা শহরে। এরপর ১৯৮৩ সালে আর্জেন্টিনার পাড়ি জমায় তার পূর্ব-পুরুষেরা।
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন লিওনেল মেসি। তার পিতার নাম হোর্হে হোরাসিও মেসি। যিনি পেশায় একজন স্টিল কারখানার কর্মচারী। মেসির মায়ের নাম সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি। তিনি পেশায় পার্ট টাইম ক্লিনার ছিলেন। মেসিরা মোট তিন ভাই ও এক বোন। দুই ভাই হলেন- রাদ্রিগো ও মাতিয়াস। আর একমাত্র বোনের নাম মারিয়া সল।
মেসির ছেলেবেলা
মেসির বয়স যখন মাত্র ১১ বছর, তখনই গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সিতে ভোগেন। কিন্তু ছোট্ট এই মেসির প্রতি সেসময়েই স্থানীয় ক্লাব পাওয়ার হাউস ও রিভার প্লেট তার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে জরুরি ৯০০ ডলার খরচ করতে রাজি হয়নি কোনো ক্লাবই। তখনই তার ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
কিন্তু আজকের এই মেসির ক্যারিয়ার সেখানেই থেমে যায়নি। এফসি বার্সেলোনার তত্কালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লেস রেক্সাচের চোখে পড়েন মেসি। একটি ন্যাপকিন পেপারে মেসির বাবার সঙ্গে চুক্তিও করে ফেলেন তিনি। সেই সুবাদে বার্সেলোনায় পাড়ি জমায় মেসি ও তার পরিবার। আর সেখানে বার্সেলোনার যুব একাডেমী লা মাসিয়াতে ভর্তি হন মেসি।
বার্সেলোনায় যাত্রা শুরু
মেসি ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনার যুব ক্লাবের হয়ে খেলা চালিয়ে যান লিওনেল মেসি। সেখানে ভালো পারফরম্যান্স করলে বার্সার সি দলে সুযোগ পেয়ে যান এই আর্জেন্টাইন। সেখানেও কোচের প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফরম্যান্স দেখিয়ে বি ক্লাবে ঢুকে যান মেসি।
২০০৪ সালটা মেসির জন্য সৌভাগ্যের সময়। কেননা এ বছর তিনি বার্সেলোনার মূল দলে জায়গা করে নেন। সে বছরের ১৬ অক্টোবর এস্পানিঅলের বিপক্ষে লা লিগায় অভিষেক হয় মেসির। আর এর মধ্য দিয়ে বার্সেলোনার তৃতীয় কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে মেসির লা লিগায় অভিষেক হয়। আর ২০০৫ সালের পহেলা মে বালোম্পাইয়ের বিপক্ষে বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগায় গোল কনে রেকর্ড গড়েন তিনি। তবে সেই রেকর্ড আর নেই।
সেই ২০০৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ২১ বছর বার্সেলোনার হয়েই খেলেছেন লিওনেল মেসি। এ সময় তিনি গড়েছেন অসংখ্য রেকর্ড এবং জিতেছেন অসংখ্য ট্রফি। ৫২০ ম্যাচ খেলে করেছেন ৪৭৪টি। লা-লিগায় আর্জেন্টিনার জার্সিতে জিতেছে মোট ১০টি লিগ ট্রফি। কোপা ডেল রেতে বার্সাকে মোট সাতবার ট্রফি এনে দিয়েছেন মেসি। এছাড়া চারবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং তিনবার করে সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন।
এরপর ২০২১ সালে যোগ দেন ফরাসি জায়ান্ট ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনে। এখন পর্যন্ত ৪৬টি ম্যাচ খেলে করেছেন ১৮টি গোল। সেখানে লিগ ওয়ানে পিএসজির হয়ে একবার লিগ চ্যাম্পিয়নের ট্রফি জেতেন মেসি।
সাত ব্যালন ডি’অরের গল্প
২০০৪ সালে বার্সেলোনার হয়ে অভিষেক হওয়ার পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি লিওনেল মেসিকে। ২০০৭ সালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও কাকার সঙ্গে ব্যালন ডি’অরের সংক্ষিপ্ত লিস্টে জায়গা করে নেন। যদি সেবার জিততে পারেননি মেসি।
ফুটবলের জাদুকর খ্যাত মেসির ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতার গৌরব অর্জন করেন। পরের বার তাকে রোনালদো পেছনে ফেললেও ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে টানা তিনবার এই পুরস্কার নিজের করে নেন মেসি। ২০১৬ সালে জেতেন নিজের পঞ্চম ব্যালন ডি’অর। আর ২০১৬ সালে জেতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ব্যালন ডি’অরের মালিক হন মেসি। ২০২১ জিতে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।
আর্জেন্টিনা জাতীয় দল ও মেসি
বার্সেলোনায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখালে স্পেনের বয়সভিত্তিক দলে খেলার অফার পান লিওনেল মেসি। কিন্তু মাতৃভূমিকে ধোঁকা দিতে চাননি এই সুপারস্টার। তাই স্পেনের অফার ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলে। ক্রমান্বয়ে সুযোগ পেয়ে যান আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২৩ দলেও।
লিওনেল মেসি জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন ২০০৫ সালের আগস্টে। ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে গোল করার মধ্য দিয়ে তিনি সর্বকনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০০৭ কোপা আমেরিকায় তিনি সেরা যুব খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেন। ওই আসরে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।
আর্জেন্টিনার জার্সিতে এখন পর্যন্ত খেলেছেন ১৭২টি ম্যাচ। গোল করেছেন মোট ৯৮টি। আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটিও রয়েছে তার নামের পাশে। ২০২১ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম শিরোপা জেতেন মেসি।
সেবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে ১-০ গোলে হারিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। পরের বছরই কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে হারিয়ে জেতেন ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা। আর এর মাধ্যমে ফুটবল ইতিহাসে কোনো শিরোপা জেতা বাকি নেই এই জীবন্ত ফুটবল কিংবদন্তির।
ক্রিফোস্পোর্টস/২৭ফেব্রুয়ারি২৩/এমএম