বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিভার আরেক নাম সিদ্দিকুর রহমান। দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে নিজেকে একজন সফল আন্তর্জাতিক গলফার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার এই যাত্রা শুধু একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে নয় বরং একজন সংগ্রামী মানুষের গল্পও।
সিদ্দিকুর রহমানের শৈশব
১৯৮৪ সালের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সিদ্দিকুর রহমান। তার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল না। বাবা ছিলেন একজন কৃষক এবং মা গৃহিণী। শৈশবে তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। ছোটবেলায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করে সংসারে সহায়তা করতেন। তবে খেলাধুলার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তবে তখনও তিনি জানতেন না তার জীবনের গন্তব্য গলফের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
গলফের হাতেখড়ি
সিদ্দিকুরের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ঢাকার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে বল বয় হিসেবে কাজ করার সময়। তিনি ১০ বছর বয়সে এই কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে বল বয় হিসেবে কাজ করলেও খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে দেখতে তার মধ্যে গলফের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বল কুড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে তিনি নিজেই ভাঙা স্টিক দিয়ে অনুশীলন করতে থাকেন। তার খেলার প্রতি ভালোবাসা এবং শেখার আগ্রহ দেখে ক্লাবের অনেক খেলোয়াড় তাকে উৎসাহ দিতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন :
» আসিফ হোসেন খান, রাইফেলের ফুলকিতে সোনা জয়ের গল্প
» পিএসএলে শোয়েব আখতারের কাছে শেখার আগ্রহ নাহিদের
» স্যার গারফিল্ড সোবার্স, কিংবদন্তির জীবনকথা
অপেশাদার গলফ ক্যারিয়ার
কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে কাজ করতে করতেই সিদ্দিকুরের দক্ষতা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতে অংশ নিতে শুরু করেন। ২০০০ সালে তিনি জাতীয় পর্যায়ে গলফ প্রতিযোগিতায় নজর কাড়েন। যদিও তিনি তখনো কোনো পেশাদার কোচিং পাননি, তবে নিজের প্রচেষ্টায় খেলার কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হন।
পেশাদার গলফ ক্যারিয়ারের শুরু
সিদ্দিকুর রহমান পেশাদার গলফ ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৫ সালে। প্রথম দিকে তার আর্থিক সংকট ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। ২০০৯ সালে এশিয়ান ট্যুর কার্ড অর্জন করেন। এটি তার ক্যারিয়ারের একটি বড় মাইলফলক। বাংলাদেশের গলফ ইতিহাসে তিনি প্রথম ব্যক্তি, যিনি এশিয়ান ট্যুরে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
সাফল্যের গল্প
- ব্রুনেই ওপেন জয় (২০১০)
- ইন্ডিয়ান ওপেন জয় (২০১৩)
- অলিম্পিকে অংশগ্রহণ ২০১৬
ব্রুনেই ওপেন জয় (২০১০)
সিদ্দিকুরের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ২০১০ সালে ব্রুনেই ওপেন টুর্নামেন্টে। তিনি এশিয়ান ট্যুরের প্রথম বাংলাদেশি চ্যাম্পিয়ন হন। এই জয় তাকে আন্তর্জাতিক গলফ অঙ্গনে পরিচিত করে তোলে। এরপর থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে থাকেন।
ইন্ডিয়ান ওপেন জয় (২০১৩)
২০১৩ সালে সিদ্দিকুর ইন্ডিয়ান ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হন। এটি তার দ্বিতীয় বড় আন্তর্জাতিক জয়।
অলিম্পিকে অংশগ্রহণ (২০১৬)
২০১৬ সালে সিদ্দিকুর রহমান রিও ডি জেনেইরো অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রথম গলফার হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এই অলিম্পিকে তিনি দেশের পতাকা বহন করেন, যা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায়। তার এই অর্জন দেশের গলফ ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
জীবনের প্রতিকূলতা
সিদ্দিকুর রহমানের জীবনে চ্যালেঞ্জের কোনো অভাব ছিল না। প্রথম দিকে গলফের সরঞ্জাম কেনার মতো অর্থ ছিল না। ভাঙা স্টিক দিয়ে অনুশীলন করেছেন তবুও তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময়ে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবে প্রতিটি ইনজুরি থেকে ফিরে এসেছেন আরও শক্তিশালী হয়ে।
ব্যক্তিগত জীবন
সিদ্দিকুর রহমান অত্যন্ত বিনয়ী এবং প্রচারবিমুখ। তার স্ত্রী ফারজানা সিদ্দিক এবং তাদের দুই সন্তান রয়েছে। তিনি সব সময় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
সিদ্দিকুর রহমান শুধু একজন খেলোয়াড়ই নন বরং বাংলাদেশের গলফকে উন্নত করার জন্য একজন অগ্রদূত। তিনি তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
ক্রিফোস্পোর্টস/১৪জানুয়ারি২০২৫/আইএইচআর/এসএ