বেসবল—যা আমেরিকান ক্রিকেট। ব্যাট বলের ডামাডোল বাজানো এই খেলায় প্রতিনিয়তই লেখা হয় নতুন গল্প। কোনো গল্প সাফল্যের, কোনো গল্প ব্যর্থতার। আবার কোনো গল্প বিপ্লবের। কখনো কখনো এমন কোনো মহাতারকার আবির্ভাব হয় যিনি কিনা সাফল্য-ব্যর্থতা ও বিপ্লব মিলিয়ে তৈরি করে অনবদ্য গল্প। তেমনই এক কিংবদন্তি জ্যাকি রবিনসন
জ্যাকি রবিনসনের জীবন সংগ্রাম
জ্যাকি রবিনসন ১৯১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি, জর্জিয়ার কায়রো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পর থেকে জীবন শুরু হয়েছিল অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। তার বাবা, জেরি রবিনসন পরিবারের পাশে ছিলেন না। তার খুব ছোট বয়সেই বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান। তার মা, ম্যালি রবিনসন, একা হাতে পাঁচ সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে তাদের লালনপালন করেন।
ম্যালির কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষা ও মূল্যবোধ ছিল পরিবারের মূল ভিত্তি। পরিবারের অভাবের মধ্যেও, ম্যালি তার সন্তানদের শিক্ষায় গুরুত্ব দেন। পাসাডেনা শহরে পৌঁছানোর পর, জ্যাকি সেখানে পাসাডেনা সিটি কলেজে ভর্তি হন এবং শিক্ষার পাশাপাশি নানা ধরনের খেলায় অংশ নেন। তার ক্রীড়া প্রতিভা দ্রুতই উন্মোচিত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন
» স্যার গারফিল্ড সোবার্স, কিংবদন্তির জীবনকথা
» ভাঙা স্টিক দিয়ে শুরু, গলফার সিদ্দিকুরের গল্পটা যেন স্বপ্নের মতো
» তামিমের ফিফটিতে ঢাকাকে হারিয়ে দুইয়ে উঠে এলো বরিশাল
শিক্ষা ও ক্রীড়া জীবন
জ্যাকি রবিনসন যখন UCLA (ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেস) ভর্তি হন তখন সেখানে তার ক্রীড়া দক্ষতার স্বীকৃতি পাওয়া শুরু হয়। সেখানে তিনি এককভাবে চারটি ভিন্ন খেলায় (ফুটবল, বাস্কেটবল, ট্র্যাক, এবং বেসবল) লেটারম্যান হন, যা সে সময় একটি বিরল এবং অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয় এবং তিনি সেখান থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
সামরিক জীবন ও বর্ণবৈষম্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জ্যাকি রবিনসন মার্কিন সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। সেখানে তাকে বিভিন্ন বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে হয়, তবে তিনি কখনও তার সংগ্রামের মনোবল হারাননি। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে, যখন তিনি টেক্সাসের ফোর্ট হুডে সাদা নাগরিকদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসেন, যার জন্য তাকে সামরিক আদালতে হাজির হতে হয়। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তার জন্য শাস্তি না পেয়ে মুক্তি পান।
নিগ্রো লিগ বেসবলে যোগদান
যুদ্ধ থেকে অবসর নেওয়ার পর, জ্যাকি রবিনসন কানসাস সিটি মনার্কসের নিগ্রো লিগে বেসবল খেলা শুরু করেন। এই লিগে খেলতে গিয়ে তার প্রতিভা আরও বিকশিত হয় এবং খেলার প্রতি তার ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। তার সামর্থ্য ব্রাঞ্চ রিকি, ব্রুকলিন ডজার্সের জেনারেল ম্যানেজারের নজর কাড়ে। রিকি রবিনসনকে মেজর লিগে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই মুহূর্ত ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যেখানে রবিনসন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।
মেজর লিগে আত্মপ্রকাশ ও সংগ্রাম
১৯৪৭ সালের ১৫ এপ্রিল, জ্যাকি রবিনসন ব্রুকলিন ডজার্সের হয়ে মেজর লিগ বেসবলে আত্মপ্রকাশ করেন। এটি ছিল বেসবলের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। রবিনসন ছিলেন প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান খেলোয়াড়, যিনি মেজর লিগে খেলার সুযোগ পান।
এই মুহূর্তটি শুধু বেসবল নয়, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। তবে, তার এই সাফল্য সহজে আসেনি। তিনি প্রতিনিয়ত বর্ণবাদী আচরণের শিকার হন—প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়, দর্শক এবং এমনকি তার সতীর্থরা পর্যন্ত তাকে অবজ্ঞা করতেন। তবে, জ্যাকি তার দৃঢ়তা এবং ধৈর্যের সঙ্গে সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেছিলেন।
মেজর লিগে খেলার সময় জ্যাকি রবিনসনের প্রতি অগণিত অপমান, অবমাননা, এবং বর্ণবাদী মন্তব্য ছিল কিন্তু তিনি কখনও হতাশ হননি। তার চমৎকার পারফরম্যান্স এবং পরিশ্রমের কারণে ধীরে ধীরে তাকে শ্রদ্ধা জানানো শুরু হয়। জ্যাকি জানতেন, তার সংগ্রাম শুধু তার নিজের জন্য নয় বরং আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্যও একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল—বর্ণবৈষম্য ভাঙা।
ক্রীড়া সাফল্য ও অবসর
১৯৪৭ সালে মেজর লিগে আত্মপ্রকাশের পর, জ্যাকি রবিনসন তার ক্যারিয়ার জুড়ে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। তিনি রুকি অব দ্য ইয়ার পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৪৯ সালে তিনি ন্যাশনাল লিগের মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার (MVP) নির্বাচিত হন।
তার ব্যাটিং গড় ছিল .৩১১, এবং তিনি ছয়বার অল-স্টার নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে, ব্রুকলিন ডজার্স ১৯৫৫ সালে ওয়ার্ল্ড সিরিজ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে, যা দলের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল। ১৯৫৭ সালে তিনি অবসর নেন। তার অবসর কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না, কারণ তিনি শুধুমাত্র খেলার জন্য নয় বরং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের জন্য ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকেন।
সামাজিক আন্দোলনে ভূমিকা
বেসবল থেকে অবসর নেওয়ার পর, জ্যাকি রবিনসন তার জীবনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককেও গুরুত্ব দেন—সামাজিক আন্দোলন। তিনি নাগরিক অধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের দাবি করেন। তিনি NAACP (ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালর্ড পিপল)-এর সঙ্গে কাজ করেন এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নানা স্তরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি একসময় একটি বড় কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্টও হন, যা ছিল তার জীবনের আরেকটি মাইলফলক। তার সামাজিক ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি এক নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে মানুষ তাদের জাতি বা বর্ণ অনুযায়ী বৈষম্যের শিকার হবে না।
ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবার
জ্যাকি রবিনসন ১৯৪২ সালে রোজি হলিন্সের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই ছেলে—অর্থার এবং ডেভিড রবিনসন। পরিবার ছিল তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তার স্ত্রীরও নাগরিক অধিকার আন্দোলনে ভূমিকা ছিল। জ্যাকি তার পরিবারকে জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল এবং দৃঢ় মনোভাব শিখিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে তার সন্তানদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
জ্যাকি রবিনসন ১৯৭২ সালের ২৪ অক্টোবর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মেজর লিগ বেসবল ১৯৯৭ সালে তার জার্সি নম্বর ৪২ উঠিয়ে রাখে, যা একটি বিরল সম্মান। প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল “জ্যাকি রবিনসন ডে” হিসেবে পালিত হয়, যেখানে সব খেলোয়াড় তার সম্মানে ৪২ নম্বর জার্সি পরেন। তিনি কেবল একটি খেলার ইতিহাসই রচনা করেননি বরং তার সংগ্রামী জীবন বর্ণবৈষম্য দূরীকরণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিলেন।
জ্যাকি রবিনসননের—জীবন ও ক্রীড়া এবং সামাজিক আন্দোলন অনুপ্রেরণার এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে রয়েছে। তিনি শুধু মেজর লিগ বেসবলে প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান খেলোয়াড় ছিলেন না বরং তিনি আমেরিকান সমাজের বর্ণবৈষম্য ভাঙার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
ক্রিফোস্পোর্টস/১৬জানুয়ারি২০২৫/আইএইচআর/এসএ