ইমরান খান একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার, সফল রাজনীতিবিদ এবং মানবসেবায় নিবেদিত প্রাণ। পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি একাধিক ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার জীবন বর্ণনা করা শুধু একটি গল্প নয়, এটি সংগ্রাম, সাফল্য, এবং প্রতিশ্রুতির এক অসাধারণ উদাহরণ।
পরিচয় ও শৈশবকাল
ইমরান আহমদ খান নিয়াজি ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানের পশতু-জাতি গোত্রের নিয়াজি শাখার অন্তর্গত এবং তার পরিবারের ঐতিহ্য ছিলো সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত। তার পিতামাতা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি এবং শওকত খানম ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষ। ইমরান ছোটবেলা থেকেই একটি সুশৃঙ্খল পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে শিক্ষা, ধর্ম এবং নৈতিকতার গুরুত্ব দেওয়া হতো।
ইমরানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় লাহোরের অ্যাচিসন কলেজে, যা পাকিস্তানের অন্যতম সেরা স্কুল। পরে তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তার শৈশবের অনেকটা সময় কাটে। এখানেই তিনি ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটান। স্কুল পর্যায়েই তার অসাধারণ ক্রিকেট প্রতিভার কারণে তিনি সহপাঠীদের মধ্যে আলাদা পরিচিতি পান।
আরও পড়ুন :
» সেরেনা উইলিয়ামস : একটি নাম, একজন কিংবদন্তি
» ছক্কায় শুধু ক্রিস গেইলকে ছোঁয়া বাকি তানজিদের
» রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী : এক অদম্য যুগলের গল্প
এরপর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক করতে যান। ইংল্যান্ডে তার শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি আরও পরিণত হয়। শৈশব এবং কৈশোরে ইমরান তার ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব গুণে অন্যদের থেকে ভিন্ন ছিলেন। তিনি তার সহপাঠীদের অনুপ্রেরণা দিতেন এবং নতুন কিছু শেখার প্রতি উদগ্রীব থাকতেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার : কিংবদন্তির উত্থান
১৯৭১ সালে ১৮ বছর বয়সে ইমরান খান পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলে অভিষেক করেন। অভিষেক ম্যাচেই তার দক্ষতা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। তবে প্রথমদিকে তার পারফরম্যান্স ছিলো সাধারণ মানের। ইমরান তার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিজের ওপর কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যান।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৮০-এর দশকে তিনি একজন অসাধারণ অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ব্যাটিং এবং বোলিং উভয় ক্ষেত্রেই তার পারদর্শিতা ছিল অনন্য। ১৯৮২ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার পর তিনি দলকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যান।
১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইমরানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। পাকিস্তান দল একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় করে। এই জয় শুধু পাকিস্তানের জন্যই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসেও এক বিরল ঘটনা। ইমরান খানের “কোনো কিছুই অসম্ভব নয়” এই মন্ত্রে দলকে উজ্জীবিত করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
ইমরান খানের ব্যক্তিগত জীবন সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। তিনি ১৯৯৫ সালে জেমাইমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন, যিনি ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত এবং একজন লেখক ও সমাজসেবী। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে—সুলাইমান এবং কাসিম।
তবে এই দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, এবং ২০০৪ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন। এরপর তিনি সাংবাদিক রেহাম খানকে বিয়ে করেন, তবে তাদের সম্পর্ক মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়। ২০১৮ সালে তিনি বুশরা মানেকাকে বিয়ে করেন, যিনি একজন ধর্মীয় পণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক গুরু।
দাতব্য কার্যক্রম
ইমরান খানের সবচেয়ে বড় দাতব্য কার্যক্রম হলো তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল। এটি পাকিস্তানের প্রথম দাতব্য ক্যান্সার হাসপাতাল, যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি নামাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পাকিস্তানের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান করে।
রাজনৈতিক যাত্রা
ইমরান খান ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি জনগণের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পাননি। তবে তিনি হাল ছাড়েননি।
২০১৮ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে অর্থনীতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যদিও তার শাসনামল সমালোচনার মুখোমুখি হয়, তবুও তিনি দেশের যুবসমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা।
ইমরান খান এমন একজন ব্যক্তি, যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ক্রিকেট থেকে রাজনীতি এবং মানবসেবায় তার অবদান তাকে একজন কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার জীবনের গল্প সংগ্রাম, অধ্যবসায়, এবং নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ক্রিফোস্পোর্টস/২২জানুয়ারি২০২৫/আইএইচআর/এসএ