ফুটবলের ইতিহাসে এমন কিছু নাম রয়েছে যেগুলো শুধু প্রতিভা নয়, শিল্পের মূর্ত প্রতীক। জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান তাদের মধ্যে অন্যতম। ফ্রান্সের নিম্নবিত্ত পাড়ার এক সাধারণ ছেলে থেকে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ মঞ্চে ওঠা—জিদানের জীবন গল্প অনুপ্রেরণার এক অনন্য নিদর্শন। তার অসাধারণ ড্রিবলিং, পাসিং, এবং খেলার কৌশল তাকে ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় স্থায়ী করেছে।
মাঠে তার মাধুর্যপূর্ণ উপস্থিতি, শান্ত নেতৃত্ব এবং ঐতিহাসিক সাফল্য আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে অমলিন। ফুটবলপ্রেমীদের জন্য, জিদান শুধুই একজন খেলোয়াড় নন, এক চিরস্থায়ী কিংবদন্তি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান ১৯৭২ সালের ২৩শে জুন ফ্রান্সের মার্সেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার আলজেরিয়ার কবিলি অঞ্চল থেকে ফ্রান্সে অভিবাসিত হয়েছিল। জিদানের বাবা ইসমাইল এবং মা মালিকা, মার্সেই শহরের একটি শ্রমিকশ্রেণির এলাকায় বসবাস করতেন। পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ জিদান বেড়ে উঠেছেন “লা ক্যাস্তেলান” নামে একটি নিম্নবিত্ত এলাকা, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিনিয়ত।
আরও পড়ুন :
»ইমরান খান : এক কিংবদন্তির উত্থান যেভাবে
» আতহার আলী খান : ব্যাট ছেড়ে মাইক্রোফোন হাতে এক সৈনিকের গল্প
» চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিরাপত্তা নিয়ে কঠোর অবস্থানে পাকিস্তান
তবে তার শৈশবের প্রধান আশ্রয় ছিল ফুটবল। রাস্তার ফুটবল ছিল তার জীবনের প্রথম শিক্ষক। ছোটবেলায় তিনি তার প্রথম ফুটবল খেলার সেট উপহার পান, যা তাকে এই খেলাটির প্রতি গভীর ভালোবাসার দিকে টেনে নিয়ে যায়।
কর্মজীবনের শুরু
জিদানের প্রতিভা প্রথমে লক্ষ্য করেন স্থানীয় এক কোচ। তিনি তাকে ফুটবলের পেশাদার জগতে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৮৬ সালে জিদান ফ্রান্সের কান ক্লাবের যুব একাডেমিতে যোগ দেন। এখানেই তার প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি কানের হয়ে পেশাদার ফুটবল অভিষেক করেন। তার প্রথম মরসুমেই তার খেলার স্টাইল এবং প্রতিভা সবাইকে মুগ্ধ করে।
বোর্দো
১৯৯২ সালে তিনি যোগ দেন বোর্দো ক্লাবে, যেখানে তার খেলার মান আরো উন্নত হয়। এই ক্লাবে তিনি মাধুর্য পূর্ণ পাসিং, অসাধারণ ড্রিবলিং এবং দুর্দান্ত কৌশলের মাধ্যমে ইউরোপের ফুটবল বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়েন। বোর্দোর হয়ে তিনি ১৯৯৫ সালে ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে পৌঁছান। যদিও তারা ফাইনালে হেরে যায়, জিদানের অসাধারণ পারফরম্যান্স তাকে ইউরোপীয় বড় ক্লাবগুলোর কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।
জুভেন্টাস
১৯৯৬ সালে জিদান ইতালির শীর্ষ ক্লাব জুবেন্টাসে যোগ দেন। এখানে তার দক্ষতা আরো পরিপক্ব হয়। তার নেতৃত্বে জুবেন্টাস সিরি আ (ইতালির লিগ শিরোপা) জেতে ১৯৯৬-৯৭ এবং ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে। তিনি জুবেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে দুটি বার অংশ নেন। যদিও তার দল শিরোপা জিততে ব্যর্থ হয়, তার পারফরম্যান্স তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারে পরিণত করে।
এই সময়ে জিদান ব্যালন ডি’অর তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেন এবং ১৯৯৮ সালে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি জেতেন।
রিয়াল মাদ্রিদ এবং বিশ্বখ্যাতি
২০০১ সালে রিয়াল মাদ্রিদ জিদানকে ৭৭.৫ মিলিয়ন ইউরোতে দলে ভেড়ায়, যা তখনকার সময়ে বিশ্ব ফুটবলে একটি রেকর্ড স্থানান্তর ফি ছিল। এই সময়ে, রিয়াল মাদ্রিদ “গ্যালাক্টিকোস” দল গঠনে মনোযোগী ছিল। জিদান, রাউল, ফিগো, রোনালদো নাজারিও, এবং বেকহ্যামের মতো তারকারা এই দলে ছিলেন।
২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিদানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত আসে ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে। বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে তিনি বাঁ পায়ের একটি দুর্দান্ত ভলির মাধ্যমে গোল করেন। এই গোলটি ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্বকাপ ১৯৯৮
জিদানের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি পায় ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে। ফ্রান্সের হয়ে খেলতে গিয়ে তিনি দুইটি গোল করেন ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে। তার অসাধারণ নেতৃত্ব এবং পারফরম্যান্সে ফ্রান্স প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে। এই জয় ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকে।
২০০৬ বিশ্বকাপ
২০০৬ সালের বিশ্বকাপে জিদান তার ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়ে ছিলেন। তিনি পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন এবং ফ্রান্সকে ফাইনালে পৌঁছে দেন। তবে ফাইনালে ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জির সঙ্গে বিবাদে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। সেই ম্যাচেই ফ্রান্স হারার পর তিনি অবসরের ঘোষণা দেন।
কোচিং ক্যারিয়ার
জিদানের কোচিং ক্যারিয়ারও তার খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই উজ্জ্বল। ২০১৬ সালে তিনি রিয়াল মাদ্রিদের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার কোচিংয়ে দলটি টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে। এ ছাড়া লা লিগা, স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপসহ মোট ১১টি শিরোপা জিতে রিয়াল মাদ্রিদকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
জিদানের পরিবার
জিদানের ব্যক্তিগত জীবনও তার ক্যারিয়ারের মতোই অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি তার স্ত্রী ভারোনিক ফার্নান্দেজের সঙ্গে সুখী দাম্পত্য জীবনযাপন করছেন। তাদের চার ছেলে—এঞ্জো, লুকা, থিও এবং এলিয়াস—যারা প্রত্যেকেই ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়েছেন।
সর্বকালের সেরা
জিনেদিন জিদান কেবল একটি নাম নয়, এটি ফুটবলের একটি অধ্যায়। তার মতো খেলোয়াড় ও কোচ খুব কমই দেখা যায়। তার খেলায় শৈল্পিকতা এবং শৃঙ্খলা ফুটবলপ্রেমীদের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।জিদান শুধুমাত্র একজন ফুটবলার নন, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতা এবং উদাহরণস্বরূপ ক্রীড়াবিদ। তার অসাধারণ কর্মজীবন, শৃঙ্খলা এবং ফুটবল প্রতিভা তাকে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
ক্রিফোস্পোর্টস/২৩জানুয়ারি২০২৫/আইএইচআর/এসএ