ফুটবল ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত থাকে যা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকে—কখনও তা গৌরবময়, কখনও করুণ। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জিনেদিন জিদানের লাল কার্ড পাওয়া এমনই এক ঘটনা, যা ফুটবলপ্রেমীদের মনে গভীর দাগ কেটেছে। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে এমন এক বিদায় নেওয়া ছিল অভাবনীয়, বিশেষ করে একজন খেলোয়াড়ের জন্য, যিনি ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন।
বিশ্বকাপ ২০০৬ : ফ্রান্সের ফাইনালে ওঠার গল্প
জিনেদিন জিদান, একজন অসাধারণ মিডফিল্ডার, যিনি ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। এরপর ২০০৬ বিশ্বকাপে ৩৪ বছর বয়সী এই তারকা জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তবে ফ্রান্সের দুর্বল পারফরম্যান্স দেখে তিনি ফিরে আসেন এবং দলকে নেতৃত্ব দেন।
ফ্রান্সের যাত্রা শুরুটা সহজ ছিল না, তবে শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ব্রাজিলকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। এরপর সেমিফাইনালে পর্তুগালকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ফ্রান্স, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইতালি।
আরও পড়ুন :
» পিএসএল ২০২৫ : প্লেয়ার্স ড্রাফট শেষে কে কোন দলে?
» আবারও দক্ষিণ আফ্রিকাকে কাঁদিয়ে শিরোপা জয় ভারতের
ফাইনাল ম্যাচ : নাটকীয়তার শুরু
৯ জুলাই ২০০৬, বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ফাইনাল ম্যাচটি। ম্যাচের ৭ মিনিটের মাথায় ফ্রান্স পেনাল্টি পায়, এবং জিদান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে “পানেনকা” স্টাইলে গোল করেন, যা আজও ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম আইকনিক মুহূর্ত। তবে ইতালি দ্রুতই ফিরে আসে, এবং মার্কো মাত্তেরাজ্জি ১৯তম মিনিটে হেডে গোল করে সমতা ফেরান।
পুরো ম্যাচটি ছিল উত্তেজনায় ভরা। দুই দলই গোল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, কিন্তু নির্ধারিত ৯০ মিনিটের মধ্যে আর গোল হয়নি। অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ গড়ায়, যেখানে আরও নাটকীয় কিছু অপেক্ষা করছিল।
মাত্তেরাজ্জির সঙ্গে সংঘর্ষ : লাল কার্ডের মুহূর্ত
১১০ মিনিটের মাথায় ঘটে সেই বিখ্যাত ঘটনা। জিদান এবং ইতালির ডিফেন্ডার মাত্তেরাজ্জির মধ্যে কথার লড়াই চলছিল। হঠাৎই জিদান রাগের মাথায় মাত্তেরাজ্জির বুকে মাথা দিয়ে আঘাত করেন!
ম্যাচ অফিশিয়ালরা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেননি, তবে ভিডিও রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রেফারি হর্হে লারিওন্দা সরাসরি লাল কার্ড দেখিয়ে জিদানকে মাঠ ছাড়ার নির্দেশ দেন। তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ এবং বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো একটি মঞ্চ থেকে এভাবে বিদায় নেওয়া ছিল অবিশ্বাস্য এবং হৃদয়বিদারক।
পরে জানা যায়, মাত্তেরাজ্জি জিদানের পরিবারের বিষয়ে অপমানজনক মন্তব্য করেছিলেন, যা সহ্য করতে না পেরে জিদান প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি স্বীকারও করেন যে এটি তার ভুল ছিল, তবে একইসঙ্গে বলেন, “যদি কেউ আমার মায়ের বা বোনের অপমান করে, তাহলে আমি এভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাব।”
ফ্রান্সের পরাজয় ও জিদানের বিদায়
জিদানের বিদায়ের পর ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়, যেখানে ইতালি ৫-৩ ব্যবধানে পেনাল্টিতে জিতে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। ফ্রান্সের হয়ে শেষবারের মতো মাঠে থাকা জিদান সেই মুহূর্তে ড্রেসিংরুমে ছিলেন, ফাইনাল শেষেও আর মাঠে আসেননি।
এই লাল কার্ড তার ক্যারিয়ারের শেষ মুহূর্তকে কলঙ্কিত করলেও, তার অসাধারণ প্রতিভা ও বিশ্বফুটবলে অবদান কেউ ভুলতে পারেনি।
জিদানের সেই লাল কার্ড পাওয়া এবং মাঠ থেকে বিদায় নেওয়া ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হয়ে আছে। এটি প্রমাণ করে যে, মহান খেলোয়াড়রাও কখনও কখনও আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল করতে পারেন।তবে দিনশেষে জিনেদিন জিদান বিশ্বফুটবলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার খেলা, নেতৃত্ব, এবং প্রতিভা তাকে ফুটবল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। বিশ্বকাপের এই লাল কার্ড তার ক্যারিয়ারের শেষ মুহূর্তের ট্র্যাজেডি হলেও, ফুটবলপ্রেমীদের মনে তিনি চিরকালই একজন কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।
ক্রিফোস্পোর্টস/০২ফেব্রুয়ারি২৫/আইএইচআর/এসএ