কাগজে-কলমে অ্যালিস্টার নাথান কুক৷ তবে ডাক নাম শেফ৷ নামের সঙ্গে তার ব্যাটিংও অনেকটা দক্ষ রাঁধুনীদের মতোই, যার স্বাদ কেবল পেয়েছে মাঠে কিংবা পর্দায় খেলা দেখা দর্শকরা৷ সাদা বলের ফ্রাঞ্জাইজি ক্রিকেটে যখন অর্থের ঝনঝনানির জয়জয়কার চলছে, তখন লাল বলের একনিষ্ঠ পুরোহিত হিসেবে কাটিয়েছেন নিজের গোটা ক্যারিয়ার৷ টেস্ট ক্রিকেটের সত্যিকারের আভিজাত্য যারা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, তাদের মধ্যে তালিকায় নিঃসন্দেহে শুরুর দিকের একজন অ্যালিস্টার কুক৷
আজ তার ৩৯তম জন্মদিন। ১৯৮৪ সালের আজকের দিনে (২৫ ডিসেম্বর) ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন অ্যালিস্টার নাথান কুক।
ইংল্যান্ড তো বটেই বরং টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেই এক অবিশ্বাস্য চরিত্র ছিলেন কুক৷ ক্যারিয়ারের শুরু থেকে তার ব্যাটে যেভাবে রানের ফোয়ারা ঝরেছে, তাতে একসময় তাকে ভাবা হতো ছাড়িয়ে যাবেন কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারকে। তবে ক্যারিয়ারে নানা চড়াই-উতরাইয়ের চাক্ষুষ সাক্ষী হয়েছিলেন কুক।
শেষ বেলায় পারেননি বটে, তবে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ঠিকই শচীন টেন্ডুলকার (১৫,৯২১), রিকি পন্টিং (১৩,৩৭৮), জ্যাক ক্যালিস (১৩,২৮৯), রাহুল দ্রাবিড় (১৩,২৮৮) সঙ্গে নিজের নামটাও এঁটে দিয়েছেন অ্যালিস্টার কুক (১২,৪৭২ রান)।
গ্লৌচেস্টারশায়ারে ইঞ্জিনিয়ার বাবা ও শিক্ষিকা মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া কুকের প্রথম অভিষেক হয় এসেক্স ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মিলে যায় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলার সুযোগ৷ সুযোগটা এমনভাবে লুফে নিলেন যে, অভিষেকের পর থেকেই কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটে রানের ফোয়ারা ঝরতে থাকে। নিজের প্রথম মৌসুমে প্রায় ৫০ ব্যাটিং গড়ে রান করার পাশাপাশি এসেক্সকে শিরোপাও এনে দিয়েছিলেন।
নিয়মিত রান পেতে থাকা কুকের জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় ২০০৬ সালে নাগপুরে৷ ভারতের বিপক্ষে মার্কাস ট্রেসকোথিক্সের ইনজুরির কারণে ডাক পড়ে কুকের। তাতে নিজের প্রথম টেস্টই রাঙিয়ে দিয়েছিলেন কুক৷
নাগপুরে অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৬০ রান। আর দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ১০৪ রানের এক ঝলমলে ইনিংস। শুধু ভারতের বিপক্ষে নয়, এরপর পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা তার প্রথম টেস্টেও সেঞ্চুরি করেছেন কুক।
ভারতের বিপক্ষে শুরু, আর সেই ভারতের বিপক্ষেই ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন আজ ৩৯ বছরে পা রাখা কুক। যদিও বিদায়ী বছরটা কুকের মোটেও ভালো যায়নি ৷ ২০১৮ সালে সর্বমোট ১৮ ইনিংসে ২৮.৬৬ গড়ে করেন মাত্র ৫১৬৷ সঙ্গে ২ ফিফটি ও ১ সেঞ্চরি। ২০১২-২০১৩ এর পর কুকের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে ছিল ওই বছরই৷
ব্যাটে রান খরার সমালোচনা এক পাশে রেখে বিদায়ী টেস্টটা শেষ পর্যন্ত রেকর্ডবুকে এঁটে রেখেছিলেন কুক। অভিষেকের মত বিদায়ী টেস্টেও দুই ইনিংসে হাঁকান সেঞ্চুরি ও ফিফটি। ওভাল টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৭১ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে খেললেন ১৪৭ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস। সেঞ্চুরির পর হেলমটে খুলে ব্যাট উঁচিয়ে ধরে সেই চিরচেনা ঢঙে স্মিত হাসি। প্রায় এক যুগ আগে নাগপুরের স্মৃতিটাই আবার ফিরিয়ে আনলেন ওভালে।
এরই সঙ্গে ১৪১ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরির এক বিরল রেকর্ডবুকে নাম উঠে যায় কুকের। কুকসহ এই কীর্তি আছে রেজিনাল্ড ডাফ (অস্ট্রেলিয়া), বিল পন্সফোর্ড (অস্ট্রেলিয়া), গ্রেগ চ্যাপেল (অস্ট্রেলিয়া), মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের (ভারত)।
এর আগে ২০১০-১১ মৌসুমে ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ জিতেছিল (৩-১) ইংল্যান্ড। সে বছর কুককে আউট করার কোনো কৌশলই খুঁজে পাচ্ছিল না অজি বোলাররা। গোটা সিরিজে ক্রিজে ছিলেন ৩৬ ঘণ্টা ১১ মিনিট। ৩ সেঞ্চুরি আর ২ ফিফটিতে ৭৬৬ রান করে যে ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন কুক। ব্যাটিং গড় ১২৭.৬৬! গ্যাবা টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটাও (২৩৫*) পেয়েছিলেন ওই সিরিজেই। ফলে কুকের মাথাতেই উঠেছিল সিরিজ সেরার মুকুট।
ক্যারিয়ারে কুক মোট ৭টি অ্যাশেজ সিরিজ খেলেছেন; এর মধ্যে জিতেছেন ৪টিতেই। অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন ২টি অ্যাশেজ। কুকের নেতৃত্বে ৫৯টি টেস্ট খেলে ২৪টিতে জিতেছে ইংল্যান্ড। একমাত্র মাইকেল ভনের নেতৃত্বেই এর চাইতে বেশি (২৬টি) ম্যাচ জিতেছে দলটি। তবে অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে জয়ের পাশাপাশি রেকর্ড সংখ্যক ২২টি হারও লেখা আছে তার নামের পাশে।
পুরো ক্যারিয়ারে ১৬১ টেস্টে ৪৫.৩৫ গড়ে ১২,৪৭২ রান করেছেন৷ সঙ্গে রয়েছে ৩৩টা সেঞ্চুরি ও ৫টা ডাবল। ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ আর সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। শুধু তাই নয়, টেস্টে ওপেনার হিসেবেও সর্বোচ্চ রানের দখলদার কুক। ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নেমে ১১ হাজার ৬২৭ রান করেছেন। তার পরের আছেন কেবল সুনীল গাভাস্কার। তিনি ৯ হাজার ৬০৭ রান করেছেন। তালিকায় এর পরই আছেন গ্রায়েম স্মিথ (৯,০৩০), হেইডেন (৮,৬২৫), সেবাগ (৮, ২০৭), বয়কট (৮,০৯১)।
অ্যালিস্টার কুকের ব্যাটিং স্টাইল কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা ব্রায়ান লারা ধাঁচের আকর্ষণীয় ছিল না৷ কুকের হাতে স্ট্রোক ছিল সীমিত; কাট, পুল আর দুর্দান্ত ফ্লিক এই ৩টি শটেই করেছেন বেশিরভাগ রান। তবে ক্যারিয়ারে বেশকিছু চোখ ধাঁধানো কাভার ড্রাইভও খেলেছেন কুক৷
কুমার সাঙ্গাকারা, ব্রায়ান লারা কিংবা ভিরাট কোহলির মতো ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্য কিংবা নান্দনিকতা না থাকলেও, কুককে সবাই মনে রাখবে তার অসাধারণ শট সিলেকশন ও মনসংযোগের কারণ৷ দীর্ঘ সময় মনযোগ ধরে রেখে মাঠে এক প্রান্ত আঁকড়ে ধরে থাকতে পারতেন কুক৷ ব্যাটার হিসেবে কুকের অন্য সব অর্জনের পাশে এ অর্জনও তো কম নয়!
ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি ও ২০১৪ সালে ওয়ানডে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট টেস্ট ক্রিকেট থেকে তার ব্যাট তুলে রাখার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান।
আরও পড়ুন: পার্থ টেস্ট : পাকিস্তানের বোলিং নিয়ে বিস্ময়
ক্রিফোস্পোর্টস/২৫ডিসেম্বর২৩/টিএইচ/এসএ