ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি সাফল্যে জড়িয়ে আছে জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি সফলতায় যেমন মাথা উঁচু হয় জাতির, তেমনি প্রতিটি ব্যর্থতায়ও অশ্রু সিক্ত হয়। ক্রিকেট ও ফুটবলের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় ভুলে যাওয়া নাম ক্রীড়াঙ্গনের অন্যান্য ডিসিপ্লিন। তেমনি একটি ডিসিপ্লিন—শ্যুটিং। অথচ কমনওয়েলথ গেমস এর শ্যুটিংয়ে সোনা জয়ী শ্যুটার রয়েছে বাংলাদেশের। তিনি আসিফ হোসেন খান। ১৯৮৩ সালের ১ মার্চ ঢাকায় এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তার।
আসিফ হোসেন খান বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ। তার সাফল্য দেশের শ্যুটিং খেলা ও নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তিনি দেখিয়েছেন কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে যে কোনো অসম্ভব সম্ভব করা যায়।
শৈশব ও পরিবার
আসিফের শৈশব কাটে ঢাকার একটি ব্যস্ত পাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। খেলাধুলার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। প্রথমে তার পরিবার তাকে ফুটবল এবং ক্রিকেটের প্রতি মনোযোগী করতে চেয়েছিল। তবে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর তার শ্যুটিং প্রতিভা প্রকাশ পায়।
আরও পড়ুন :
» স্যার গারফিল্ড সোবার্স, কিংবদন্তির জীবনকথা
» বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেমন ছিল তামিম ইকবাল ‘অধ্যায়’
» মিজানুর রহমান আজহারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন মিরাজ-ইমরুল
আসিফের শ্যুটিং ক্যারিয়ারের শুরু
আসিফের শ্যুটিং ক্যারিয়ার শুরু হয় পাবনা শ্যুটিং ক্লাবে। ছোটবেলায় এথলেটিক্সের প্রতি আগ্রহী থাকলেও, শ্যুটিংয়ে তার প্রতিভা দ্রুত প্রকাশ পায়। ১৯৯৯ এবং ২০০০ সালে আন্তঃক্লাব শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সাফল্যের পর, তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) শ্যুটিং দলে যোগ দেন। বিকেএসপিতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হন।
বিকেএসপিতে আসিফ শ্যুটিংয়ের নানা কৌশল রপ্ত করেন। তার প্রথম বড় অর্জন আসে বাংলাদেশ গেমসে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন, যা তার ক্রীড়া জীবনে একটি বড় উৎসাহ যোগায়।
শ্যুটার আসিফের আন্তর্জাতিক সাফল্য
কমনওয়েলথ গেমসের স্বর্ণপদক
২০০২ সালে ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে আসিফ হোসেন খান ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন। এই পদক বাংলাদেশকে শ্যুটিং খেলায় একটি নতুন পরিচিতি এনে দেয়।
কমনওয়েলথ গেমসের মঞ্চে আসিফ নিজের অসাধারণ দক্ষতা দেখান। ফাইনালে তিনি ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে স্বর্ণপদক নিশ্চিত করেন। স্বর্ণপদক জয়ের পর আসিফ পুরো দেশে প্রশংসিত হন। তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই অর্জন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি বড় প্রভাব ফেলে এবং অনেক তরুণ শ্যুটারকে উৎসাহিত করে।
সাফ গেমস ২০০৪
এই গেমসেও ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে স্বর্ণপদক অর্জন করেন, যা তার ধারাবাহিক সাফল্যের প্রমাণ।
কমনওয়েলথ গেমস ২০০৬
মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত এই গেমসে অঞ্জন কুমার সিংহকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল পেয়ার্স ইভেন্টে রৌপ্যপদক জয় করেন।
এস এ গেমস ২০০৬
শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত এই গেমসে ইমাম হোসেন ও অঞ্জন কুমারকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল টিম ইভেন্টে রৌপ্যপদক লাভ করেন।
চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা
২০০৬ সালের ২ অক্টোবর একটি দুঃখজনক ঘটনার শিকার হন আসিফ। শ্যুটিং ফেডারেশনে পুলিশের গাড়ি রাখাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গণ্ডগোলে পুলিশ তাকে বেধড়ক পিটুনি দেয়, যার ফলে তার দুই হাত আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই ঘটনার পর তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন, যা তার শ্যুটিং ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ব্যাক্তিগত জীবন
আসিফ হোসেন খানের ব্যক্তিত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি। তিনি সবসময় নতুন শ্যুটারদের উৎসাহিত করেন এবং তাদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। আসিফ হোসেন খানের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সীমিত তথ্য পাওয়া যায়। তবে জানা যায়, তার ছেলে মাশরুর বর্তমানে কোস্টারিকায় বসবাস করছেন।
মানবতার জন সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি নিলামে
২০২০ সালে করোনাভাইরাস দুর্গতদের সাহায্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস-ঐতিহাসিক সোনার পদকটি নিলামে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন আসিফ। ২০০২ সালে কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনার পদকটি জিতে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন আসিফ।
ক্রিফোস্পোর্টস/১২জানুয়ারি২০২৫/আইএইচআর/এসএ