‘সেই মূহুর্তে জীবনের আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাবলাম এটাই হয়তো পৃথিবীতে আমার শেষ কোনো মূহুর্ত।’ ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া ঋষভ পন্ত শুনিয়েছেন তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। স্টার স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় এই উইকেটকিপার ব্যাটার নিজেকে সড়ক দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়ে ‘লাকি’ বলে সম্বোধন করেছেন৷
বছরের একদম অন্তিম মূহুর্তে অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিল্লি–দেরাদুন মহাসড়কে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ঋষভ পন্ত। সেই দুর্ঘটনায় পায়ে, পিঠে ও কপালে গুরুতর আঘাত পান তিনি৷ ফলে দীর্ঘসময়ের জন্য ব্যাট-বল থেকে ছিটকে যান ভারতীয় উইকেটকিপার ব্যাটার। দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকা ঋষভ পন্তের বাইশ গজে ফিরতে আর তর সইছে না৷ আসন্ন আইপিএল অথবা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে মাঠের ক্রিকেটে দেখা যেতে পারে ঋষভ পন্তকে। তবে তাঁর আগে সেদিনের ভয়াবহ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন তিনি৷
‘ডাক্তাররা প্রথমে আমার অবস্থা দেখে খুবেই বিস্মিত হয়৷ অবশ্য গুরুতর আহত হওয়ার জন্য নয়, বরং আমি যে বেঁচে আছি এটা তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছিলো না৷ তাঁরা আমাকে বলতে শুরু করে তুমি খুবই ভাগ্যবান যে, তুমি এখনো বেঁচে আছো।’
‘প্রায় ত্রিশ দিন আমি একেবারে শয্যাশায়ী ছিলাম। একটুও নড়তে পারতাম না৷ আমি তখন ভাবতাম, আমি কি আদৌ হাঁটতে পারবো নাকি এভাবে শয্যাশায়ী হয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে৷ পরবর্তীতে আমি যখন কিছুটা সুস্থ অনুভব করি তখনো আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না৷ প্রথম দিকে আমাকে শুধু দাঁড় করানোর জন্যই আমার চতুর্দিকে চারজন মানুষ থাকতো, যারা আমাকে দাঁড়ানোর জন্য সহযোগিতা করতো৷ অথচ ছোটবেলা থেকে আমি ছিলাম স্বনির্ভর৷ নিজেই নিজের সব কাজ করতে পছন্দ করতাম৷ তাই সবার এমন সহযোগিতা আমার কাছে অসম্মানজনক মনে হতো, আমি ভাবতাম কিভাবে একটা মানুষ এতোটা অসহায় হতে পারে।’
‘এটা অবশ্যই সৌভাগ্য বলতে হবে, কারণ আমি আঘাতের ব্যাপারে কিছুটা সচেতন ছিলাম। দুর্ঘটনায় আরো গুরুতর কিছুও হতে পারতো৷ আমি ঠিক জানিনা কিভাবে আমি এমন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছি৷ যদি আমার পায়ের মাংশপেশী আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তাহলে হয়তো আমার পা কেটে ফেলতে হতো৷ এটাই আমাকে বেশি ভীত করে তুলেছিল কারণ শুরুর দিকে পায়ে অনেক ব্যথা অনুভব করতাম।’
ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার আঘাত থেকে এখন ক্রমেই সেরে ওঠছেন ঋষভ পন্ত৷ তাঁর পুরো সেরে ওঠার প্রক্রিয়া নিঃস্বার্থভাবে শুশ্রূষা করেছে তাঁর মা৷ তাই মাকেও কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলেননি পন্ত৷
‘গত কয়েক বছর ধরে আমি ড্রাইভিং করে দেরিতে বাসায় ফিরতাম৷ মা আমার দেরিতে বাসায় পৌঁছানোতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল এবং এটাকে আমার সার্বজনীন অভ্যাস বলেই জানতো। সেদিনের দুর্ঘটনার খবর শুনে মা কিছুটা বিচলিত হয়েছিল তবে তিনি যেহুতু জানতেন আমি দেরি করে সবসময় বাড়ি ফিরি। তাই এই দুর্ঘটনার জন্য দেরি করাকে দোষারোপ করেননি এবং আমাকেও না৷ বরং আমার সেরে ওঠার প্রক্রিয়ায় মা নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করেছে৷ এজন্যই সম্ভবত লোকে বলে,পরিবার আমাদের খুব ভালো করে বুঝে।’
দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ফলে দীর্ঘদিন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে পন্তকে৷ ২০২৩ আইপিএলে মাঠের বাহিরে বসে কাটিয়েছেন তিনি৷ নিজ দল দিল্লীর ম্যাচ দেখতে হয়েছে সাইড লাইনে বসে৷ ক্রিকেট থেকে এভাবে দূরে থাকাটা কঠিন ছিল তাঁর কাছে৷
‘আমি চেষ্টা করতাম খুব বেশি ক্রিকেট না দেখা। কোচরা প্রায়ই বলতেন, মাঠের বাহির থেকে খেলা দেখা খুব কঠিন। তখন দিল্লীর ম্যাচ চলছিল অথচ আমি তাঁদের নিয়মিত অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও মাঠের বাহিরে বসে আছি৷ এটা খুব পীড়াদায়ক ছিল৷’
‘ক্রিকেট দেখা এবং খেলা থেকে দূরে থাকায় আমি কিছুটা বিষন্নতায় ভুগতে থাকি৷ পরে আমি অ্যাশেজ দেখতে শুরু করি৷ ইংল্যান্ডের খেলার ধরণ আমি খুব পছন্দ করতাম কারণ তাদের খেলার ঢঙ অনেকটা আমার মতো।’
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মহেন্দ্র সিং ধোনির উত্তরসূরী হিসেবে ভাবা হতো ঋষভ পন্তকে৷ তাই অনেক ভক্তরা তাঁকে তুলনা করতেন ধোনির সাথে৷ এ তুলনাকে অবশ্য ভিত্তিহীন মনে করেন পন্ত।
‘আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারিনা মানুষ কিভাবে একজন পাঁচ শতাধিক ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারের সাথে মাত্র পাঁচ ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারের তুলনা করে৷ এটাতো ভিত্তিহীন একটা বিষয়৷ আমার কাছে উইকেট কিপিং খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল একই সাথে এটা ছিল খুব চাপের৷ মোহালিতে যখন আমি একবার স্টাম্পিং মিস করেছিলাম তখন সমগ্র গ্যালারি চিৎকার করে বলেছিল, ‘ধোনি ধোনি’৷ এটা খুবই কঠিন সময় ছিল, ওই মিসের কারণে আমি নিজের রুমে গিয়ে কেঁদেছিলাম।’
‘তাঁর(ধোনি) সাথে আমি সবকিছু শেয়ার করতাম৷ একবার আমি তাঁকে বলেছিলাম, আইপিএলে আমি উইকেট কিপিংয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি কিন্তু যখনি আর্ন্তজাতিক ম্যাচে উইকেটের পেছনে দাঁড়াই তখন আমি ঘাবড়ে গিয়ে মিস করে ফেলি৷ মাহি ভাই জবাবে আমাকে বলেছিলেন, আর্ন্তজাতিক ম্যাচ না ভেবে একটা সাধারণ ম্যাচের মতোই চিন্তা করে উইকেট কিপিং করতে থাকো৷ তাহলে এমন হওয়ার চান্স নেই৷ মাঝে মাঝে আমি মজার ছলে তাঁকে বলি, ভাই আপনি একজন কিংবদন্তি আর আমি মাত্র শুরু করেছি৷ এটা খুবই অন্যায্য যে, আপনি দল ছেড়ে আমার উপর সব চাপ রেখে গেছেন৷(হাসি)’
গুরুতর আহত হয়েও ড্রাইভিং ছাড়তে নারাজ ঋষভ পন্ত৷ ভালোবাসার কোনো জিনিসকে নাকি ছাড়া যায় না৷
‘আমি এখনো ড্রাইভিং করি, কারণ এটা আমার কাছে ভালোলাগে, আমি ড্রাইভিং করতে ভালোবাসি। বিষয়টা এমন নয় যে, আপনি জীবনে কোনো কারণে পিছিয়ে গেলে সেটা আর করবেন না৷ দুর্ঘটনার পর অনেকেই আমাকে ড্রাইভিং করতে নিষেধ করেছিল কিন্তু আমি তা শুনিনি৷ জীবনে বাঁধা-বিপত্তি আসতেই পারে, এতে পিছিয়ে যাওয়া উচিত নয়৷ আপনাকে যদি পৃথিবীর কেউই বিশ্বাস না করে কিন্তু নিজের প্রতি যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তাহলে আমি মনে করি দুনিয়ার যেকোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব।’
আরও পড়ুন: রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি
ক্রিফোস্পোর্টস/১৪ফেব্রুয়ারি২৪/টিএইচ/এমটি