Connect with us
ক্রিকেট

হেডিংলির মহাকাব্যে মুগ্ধতার নায়ক ‘বিগ বেন’ স্টোকস

বেন স্টোকস
হোয়াট অ্যান ইনিংস, হোয়াট অ্যা প্লেয়ার! ছবি: স্কাই স্পোর্টস

মাস দুয়েক আগের কথা। ওভালে ২০১৯ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের মুখোমুখি দক্ষিন আফ্রিকা। আদিল রাশিদের এক সহজ-সরল বলে স্লগ সুইপ খেললেন অ্যান্ডিল ফেহলাকওয়াই। তাঁর ভাবনায় ছিল বলটা ছক্কা না হলেও অন্তত চার তো হবে। কিন্তু মূহুর্তেই দৃশ্যপট বদলে গেলো৷ দৃশ্যপটে হাজির বেন স্টোকস৷ লাফিয়ে ওঠে এক হাতে লুফে নিলেন বলটি। পাশেই থাকা গ্যালারিতে বসা দুজন লোকের মুখের গঠন সহসা বদলে গেল, তারা শুধু বলতে চেয়েছেন, ‘ওয়াও’!

ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে ততক্ষণে নাসের হুসেইন বলেই ফেললেন,’নো ওয়ে, নো….ইউ ক্যান নট ডু দ্যাট বেন স্টোকস’। পাশাপাশি আরো একটা কথা বললেন,’ক্যাচটিকে ক্রিকেটের সেরা ক্যাচের তালিকায় রাখতেই হবে।’ সেই প্রথম ম্যাচ থেকেই গোটা টুর্নামেন্টে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন বেন স্টোকস। ফাইনালে যেন নিজের জীবনটাই বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন৷ সেদিন নিউজিল্যান্ডকে ফাইনালে অনেকটা একাই হারিয়ে দিয়েছেন।

দু’মাস পর, ২০১৯ সালের আগস্ট৷ বিশ্বকাপ জয়ের রেশ এখনো রয়ে গেছে ইংলিশদের চোখে-মুখে৷ ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ বলে কথা! তাও আবার অমন নাটকীয় ভঙ্গিতে৷ তবে বিশ্বজয়ের তৃপ্তি এক পাশে রেখে ইংলিশদের লড়তে হচ্ছে আভিজাত্য নিয়ে৷ একটা চাইভষ্ম পুনরুদ্ধার করার লড়াই৷ গত অ্যাশেজেই যেটা নিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া। এবারই তো ফিরিয়ে আনার সুযোগ!

কিন্তু প্রথম দুই টেস্টে হেরে ইংলিশদের আবারও আভিজাত্য নুয়ে পড়তে লাগলো। চারদিকে আলোচনা চললো, দু’মাস আগে বিশ্বজয়ীদের কী এমন হলো! এরই মধ্যে হেডিংলিতে বসলো তৃতীয় টেস্ট। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ১৭১ রানে জবাবে ইংল্যান্ড অলআউট মাত্র ৬৭ রানে। জো ডেনলি ছাড়া দুই অঙ্কের ঘর পেরোতে পারেনি কোনো ইংলিশ ব্যাটার৷

দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার মাঝারি ইনিংসেও ইংল্যান্ডের সামনে জয়ের জন্য লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৫৯ রান৷ প্রথম ইনিংসে শতক পেরোতে না পারা দলের সামনে সাড়ে তিনশো রানের চ্যালেঞ্জ। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা৷

আরো পড়ুন:

তাসকিনকে নিয়ে সুখবর, দেখা যেতে পারে শ্রীলঙ্কা ম্যাচে!

হাসপাতালে শরিফুল, ৩ মিনিটের ভিডিও দিলো বিসিবি

১৫ রানেই ফিরলেন দুই ওপেনার ররি ব্রান্স ও জেসন রয়। তৃতীয় উইকেট জুটিতে অধিনাক জো রুট ও জো ডেনলির ১২৬ রানের জুটি আশা দেখাচ্ছিল ইংল্যান্ডকে৷ কিন্তু ১৫৯ রান হতে না হতেই ডেনলি-রুটকে হারিয়ে সেই আশা ফিকে হয়ে যায়৷ ৫০ বলে ২ রান নিয়ে দিন শেষ করা বেন স্টোকস পরেরদিন অধিনায়ক রুটকে নিয়ে গড়েছেন কেবল ১৮ রানের জুটি৷

নাথান লায়নের বলে ওয়ার্নারকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন অধিনায়ক রুট৷ রুটের পতনের পর বেন স্টোকসের সঙ্গী হলেন জনি বেয়ারস্টো। পঞ্চম উইকেট জুটিতে দুজনের ব্যাট থেকে আসে ৮৬ রান৷ ম্যাচের ভাগ্য গড়তে এ জুটিই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু ইংল্যান্ডের ইনিংসটি তখনো নাটকীয়তা ভরপুর এক উত্থান-পতনের জলজ্যান্ত সিনেমা৷ ব্যক্তিগত ৩৬ রান করে ফেরার পর স্টোকসের ভরসা হতে পারতেন জস বাটলার৷ কিন্তু ভুল বুঝাবুঝিতে রানআউট বাটলার। একই পথ ধরলেন ক্রিস ওকস৷ হেডিংলির আকাশে আবারও দুর্যোগের ঘনঘটা৷ অজি আধিপত্যের সামনে মাথা নত করতে হবে ইংলিশদের?

পুরো হেডিংলি তখন স্টোকসের দিকে তাঁকিয়ে৷ চল্লিশ বছর আগে এই হেডিংলির ঘাসেই মহাকাব্য লিখেছিলেন ইয়ান বোথাম৷ ইংলিশরা যাকে ডাকে ‘বিফি’। ব্যাটে-বলে সেবার একাই অজিদের হারিয়ে দিয়েছিলেন৷ চল্লিশ বছর পর মঞ্চ ঠিক একই৷ তবে নায়ক ভিন্ন৷ সেদিন পর্যন্ত হেডিংলির হিরো ছিলেন একজনই–ইয়ান বোথাম৷

তবে আজ কি ভিন্ন প্লট রচিত হচ্ছে? খানিকটা সেই আশাই দেখাচ্ছিল জোফ্রা আর্চার৷ কিন্তু ৫০ বলে ২৪ রানের জুটিই তাঁর অবদান। স্টুয়ার্ট ব্রডও সেদিন কোনো রানের খাতা না খুলেই প্যাভিলিয়নে ফিরলেন৷ যার মানে দাঁড়ালো, সর্বশেষ ৪১ রানে ৫ উইকেট হারালো ইংল্যান্ড৷ উইকেটে তখন কেবল বেন স্টোকস, অপর প্রান্তে জ্যাক লিচ৷ ইংল্যান্ডের সামনে ৭৩ রানের ‘পাহাড়’। অজিদের দরকার কেবল ১ উইকেট। এতেই মিলে যাবে ছাইভষ্ম তথা অ্যাশেজ ধরে রাখার স্বাদ।

জ্যাক লিচকে নিয়ে মন্থর গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে স্টোকস৷ ফিফটির দেখা পেতে খরচ করেছেন ১৫২ বল। তার চেয়েও অবাক করার বিষয়, প্রথম বাউন্ডারি পেতে স্টোকস খরচ করেছেন ৭৫ বল৷  ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীরগতির স্টোকসকে দেখা গেল তখনি। কিন্তু না, সময়ের সাথে স্টোকসের ব্যাটে শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞের উচ্ছ্বাস, আকাশে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে হর্ষধ্বনি। লায়ন, কামিন্স, হ্যাজলেউড কেউই বাদ যাচ্ছে না স্টোকসের ব্যাট থেকে৷ সর্বশেষ ২৪ বলে নিলেন ৪৮ রান৷ এর মাঝে ফিফটি পেরিয়ে শতকও পেরোলেন, কিন্তু স্টোকসের মাঝে উচ্ছ্বাস কিংবা উদযাপনের কোনো লেশ দেখা যায়নি। সব যেন কিসের জন্য জমা রাখছেন!

মহাকাব্য রচনার জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ২ রান৷ ঠিক তখনি নাথান লায়নের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন স্টোকস। অজিদের জোরালো আবেদনে উইন্ডিজ আম্পায়ার জো উইলসন সোজা ‘না’ করে দিলেন। আগের ওভারেই জ্যাক লিচের জন্য একটা রিভিউ নষ্ট হয়েছিল, তাই এবার অজিদের হাতে নেই কোনো রিভিউ। খুব সম্ভবত ভাগ্য বিধাতার দৃষ্টিও ছিল ইংল্যান্ডের দিকে।  কেননা, আগের বলেই যে লায়নের ছেলেমানুষী ভুলের কারণে নিশ্চিত রান আউট থেকে বেঁচে ফিরেছেন স্টোকস৷

কামিন্স এলেন, ইংল্যান্ডের তখনো দরকার ওই ২ রান৷ কোনো মতে ব্যাট দিয়ে আলতো করে সিঙ্গেল নিলেন জ্যাক লিচ৷ প্রথম বারের মতো রানের খাতা খুললেন তিনিও৷ কামিন্সের চতুর্থ বলটায় ডিপ কাভার অঞ্চল দিয়ে সোজা চার। দু’হাত মেলে উচ্ছ্বাস আর উদযাপনের সবটা ঢেলে দিলেন স্টোকস৷ খানিকক্ষণ বসে রইলেন, যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না হেডিংলিতে আজ কী হয়েছিল! শেষ উইকেট জুটিতে শেষবার এমন জয় এসেছিল প্রায় ১০০ বছর আগে ক্যাপটাউনে৷

জ্যাক লিচকে নিয়ে স্টোকস গড়েন ৭৬ রানের জুটি। কিন্তু সেখানে লিচের অবদান কেবল ওই ১ রান, বাকি ৭৫ রানই আসে স্টোকসের ব্যাট থেকে৷ ৫০ বলে ২ রান করে দিন শেষ করা স্টোকস থামলেন ১৩৫ রানের অপরাজেয় ইনিংস খেলে৷

দু’মাস আগে স্টোকসে মুগ্ধ হওয়া নাসের হুসেন এবারও ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে বললেন,’হোয়াট অ্যান ইনিংস, হোয়াট অ্যা প্লেয়ার! টেক অ্যা বাউ বেন স্টোকস। দ্য অ্যাশেজ ওয়েল অ্যান্ড ট্রুলি অ্যালাইভ বিকজ অফ ওয়ান ক্রিকেটার, অ্যান্ড দ্যাট ক্রিকেটার ইজ বেঞ্জামিন স্টোকস।’

ক্রিফোস্পোর্টস/৪জুন২৪/টিএইচ 

Crifosports announcement
Click to comment

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Focus

More in ক্রিকেট