১৫ এপ্রিল, ১৯৮৯। বসন্তের এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল৷ ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৩টা ১৫ মিনিট৷ এফএ কাপের সেমিফাইনাল দেখতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় জমেছে শেফিল্ডের হিলসবরো স্টেডিয়ামে৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে এমন দ্বিগুণ দর্শক এর আগে কখনো দেখেনি হিলসবরো স্টেডিয়াম। অবশ্য দর্শকদের এমন ভিড়ের মূল কারণ ছিল লিভারপুল ও নটিংহ্যাম ফরেস্টের ম্যাচ৷ দুই দলের সমর্থকদের জন্য গ্যালারি পৃথক করা হলেও শুধু লিভারপুলের সমর্থকই ছিল প্রায় ৫০ হাজার৷
এতো ভিড় দেখে চমকে যান ম্যাচ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ৷ দর্শকদের চাপ সামলাতে না পেরে অগত্যা পুলিশের ম্যাচ কমান্ডার ডেভিড ডাকেনফিল্ড স্টেডিয়ামের আরো একটি দরজা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়৷ কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ সামনে-পেছনে মানুষের হুড়োহুড়ি। এতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কেউবা অত্যধিক মানুষের চাপে শ্বাসকষ্টে মৃত্যুবরণ করেন, আবার কেউ পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যান। মুহূর্তেই হিলসবরো স্টেডিয়াম পরিণত হয় শোক সাগরে৷ প্রাণ হারান ৯৬ জন লিভারপুল সমর্থক, আহত হন আরো ৭৬৬ জন। নিহতের মধ্যে ছিলেন ১০ বছর বয়সী লিভারপুলের কিংবদন্তী স্টিভেন জেরার্ডের চাচাতো ভাই জন পলও৷
গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একবার জেরার্ড বলেছিলেন, ‘সে লিভারপুল সমর্থক ছিল। ফুটবলকে ভীষণ ভালোবাসত। রাস্তায় খেলত। একদম আমার মতোই। শৈশব থেকেই লিভারপুলকে সমর্থন ও আমার পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে হিলসবরোর সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় নিহত আমার ভাই জন পল।’
জন পলের মতো সেদিন দেহ থেকে প্রাণ উড়ে যেতে পারতো স্টিভেন হোয়াইটলের। কিন্তু ভাগ্যই বাঁচিয়ে দেয় হোয়াইটলকে, তবে সেই ভাগ্য একদিন পরিণত হয় দুঃসহ মানসিক পীড়নে৷ সেদিন হোয়াইটল অফিসের কাজে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, ম্যাচটা আর দেখা হয়নি। তাই আগেই এক বন্ধুকে দিয়েছিলেন ম্যাচটির টিকেট৷ হোয়াইটল ভাবতেও পারেনি এই টিকেটেই হতে যাচ্ছে তাঁর বন্ধুর জীবন গল্পের সমাপ্তি। সেদিন নিহতদের ৯৬ জনের তালিকায় ঢুকে যায় তাঁর বন্ধুর নামটিও৷ হোয়াইটল কিছুতেই তা মানতে পারেনি৷
বাকি জীবন কাটান একজন ‘সারভাইভারস গিল্ট’ হিসেবে৷ হোয়াইটল মানসিকভাবে এতোটাই ভেঙে পড়েন যে, তাকে মনোবিদের শরণাপন্নও হতে হয়৷ কিন্তু তাতেও মনের ক্ষত শুকায়নি। বারবার বন্ধুর মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করতে থাকেন হোয়াইটল৷ নিজের জীবনের উপার্জন থেকে ৬১ হাজার পাউন্ড দিয়েছেন হিলসবরো মেমোরিয়াল ট্রাস্টে। এতেও যদি কিছুটা দায়মোচন করা যায়, মন্দ কী!
কিন্তু পারেননি হোয়াইটল৷ ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় ২২ বছরের মানসিক উৎপীড়ন থেকে বাঁচতে বেছে নেন এক করুণতম পথ৷ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেদিনের বন্ধুর কাছে ফিরে যান স্টিভেন হোয়াইটল৷ আজীবন হিলসবরো ট্রাজেডিতে লেখা থাকবে ৯৬ জন মানুষের নাম, কিন্তু বন্ধুর মৃত্যুর জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবা হোয়াইটলের নাম থাকবে দৃষ্টিসীমার আড়ালে, অথচ তিনিও ছিলেন এ ট্র্যাজেডির ৯৭তম শিকার৷
সেদিনের ট্র্যাজেডির পিছনে আয়োজকদের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়৷ কিন্তু পুলিশের মিথ্যে তথ্যে ফেঁসে গিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি সান এক প্রতিবেদনে এ দুর্ঘটনার জন্য লিভারপুল সমর্থকদের দায়ী করেন৷ সেজন্য দীর্ঘদিন সানেকে বয়কট করে লিভারপুলের সমর্থকরা। অবশ্য পরবর্তীতে আদালতের রায়ের পর সানের এমন ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান সাবেক সম্পাদক কেলভিন ম্যাকেঞ্জি৷
ইংল্যান্ডের ক্রীড়াক্ষেত্রের সবচেয়ে ভয়াবহ এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল আসে রায়। আদালতের বয়ানে বলা হয়, হিলসবরো ট্র্যাজেডি কোনো নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি ছিল ‘বেআইনি হত্যাকাণ্ড’। আর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল পুলিশের দায়িত্ব অবহেলার কারণে৷ আদালতের রায়ে স্বজনহারা লিভারপুলের সমর্থকরা হয়ত সাময়িক স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু মনের ক্ষত আজও তাদের শুকায়নি৷
তাই তো প্রতি বছর ১৫ এপ্রিলের দিনটিতে শোকের চাদরে ছেয়ে যায় সমগ্র লিভারপুল৷ হিলসবরো স্মৃতিসারকের সামনে জড় হন সমর্থকরা৷ ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত হন শেফিল্ডের সেই বসন্তের বিকেলে প্রাণপ্রদীপ নিভে যাওয়া ৯৬ জন সমর্থক।
আরও পড়ুন: রিয়াল মাদ্রিদের ‘গ্যালাক্টিকো’ নামের তারার হাট
ক্রিফোস্পোর্টস/৮মে২৪/টিএইচ/বিটি