ষাটের দশকে বাবা-মা দুজনেই পাড়ি জমান ডেনমার্কে। ১৯৯০ সালে তাদের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় জামাল ভূঁইয়া। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের পশ্চিমে ছোট্ট শহর গ্লুসটার্পে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা তাঁর ব্রন্ডবিতে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল জামাল বড় হয়ে মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তবে জামাল ছিলেন ফুটবলে আসক্ত৷ সেখান থেকে যেভাবে বাংলাদেশের ফুটবলে জামাল ভূঁইয়া—
সাধারণত বন্ডবিতে বেড়ে ওঠা শিশুরা ফুটবল বা মাদক–যেকোনো একটিতে ঝুঁকে পড়ে। প্রায়ই এখানে ড্রাগস নিয়ে গোলাগুলি, মারামারির ঘটনা ঘটে৷ তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যায় একমাত্র ফুটবলে৷ ছোটবেলা থেকেই এখানকার শিশু-কিশোররা ফুটবল মাঠে দ্যুতি ছড়াতে শুরু করেন৷
বাবা-মায়ের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নকে পাশ কাটিয়ে জামাল তখন মগ্ন ফুটবলে৷ বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সুযোগ হয় নিজের পরিচিত বন্ডবি ক্লাবে খেলার৷ তবে তখন ডেনমার্কের সেরা দল ছিল এফসি কোপেনহেগেন। বন্ডবি ও কোপেনহেগেন সম্পর্কে রাইভাল হিসেবে পরিচিত৷ একবার দুই দলের এক ডার্বি ম্যাচে জামাল দেখালেন নিজের ফুটবলশৈলী৷ ম্যাচের অন্তিম মূহুর্তে উইং দিয়ে ঢু্কে গোল করে পরাজিত করেন প্রতাপশালী কোপেনহেগেনকে৷ ম্যাচ শেষে কোপেনহেগেন কোচ জামালের সাথে গল্পে মেতে ওঠে৷ গল্পের সারসংক্ষেপ অনেকটা এরকম, ‘তোমাকে আমার দলে সুযোগ দিতে চাই। তুমি কি রাজি?’ কোপেনহেগেনের মতো দলকে ‘না’ বলার সুযোগ নেই৷ জামালও ব্যতিক্রম কিছু করলেন না৷ সায় দিলেন প্রতিপক্ষ কোচের কথায়৷
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই জামালের ফুটবলীয় প্রতিভা মুগ্ধ করে কোচকে৷ কোপেনহেগেন সিনিয়র দলে খেলার জন্য তখন অপেক্ষা ছিল কেবল সময়ের৷ সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল তবে এক অকস্মাৎ ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় তিলে তিলে গড়া ওঠা স্বপ্নকে।
আরও পড়ুন:
» মেসির দেশে মাঠে নেমেই জামাল ভূঁইয়ার গোল, দিলেন ভিডিও
» জামাল ভূঁইয়াদের অভিনন্দন জানালো আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। কোপেনহেগেনের রাস্তায় অন্য আট-দশটা দিনের মতোই ব্যস্ততা। তখন স্কুল থেকে ফিরছিলেন জামাল ভুঁইয়া। রাস্তায় তাঁকে দেখে এক ভদ্রলোক বলে ওঠেন, ‘আজকে দ্রুত বাসায় ফিরে যেও, রাস্তায় কোনো দেরি করো না।’ জামাল তখনও আঁচ করতে পারেননি এমন কথা কেন বললো? মিনিট কয়েক সামনের দিকে পা বাড়ালেন জামাল। সাথে সাথেই শোনা গেল গুলির শব্দ৷ কেঁপে ওঠলো সেন্ট্রাল কোপেনহেগেন৷ স্থানীয় গ্যাংদের মধ্যে চলছিল বিস্তর বন্দুকযুদ্ধ। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে আটকে যান জামাল৷ খেসারত হিসেবে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয় তাঁর শরীরে৷ হয়তো এটাই হতে পারতো জামালের জীবনের শেষ কোনো মূহুর্ত৷ কিন্তু জামাল ভূইঁয়া বলেই হয়তো তা হয়নি৷ চার-চারটি বিদ্ধ হওয়া বুলেটে জামাল কোমায় ছিলেন দুইদিন৷ হাসাপাতালের বিছানায় কাটাতে হয়েছে চার মাস৷ চোখের সামনে নিজের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের অকালমৃত্যু দেখতে পান৷
দীর্ঘ ৭ মাস পর ফুটবল মাঠে পা রাখলেন জামাল৷ দীর্ঘ বিরতিতে জং ধরেছে তাঁর খেলার ধরনে৷ আগের দুর্দান্ত প্রতাপ এখন আর নেই৷ তবে জামাল দমে যেতে রাজি নন৷ স্বপ্ন জয়ের জন্য নতুন করে তৈরি হতে চেয়েছিল৷ জামালের যুব দলের কোচ জনি লারসনের তাঁকে সবসময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন৷ এবারও বললেন,চেষ্টা করো তুমি পারবে। কিন্তু একেবারে শূণ্য থেকে শুরু করা জামাল খুব বেশি দূর আগাতে পারলেন না৷
যেভাবে বাংলাদেশের ফুটবলে জামাল ভূঁইয়া
এবার গল্প মোড় নেয় ভিন্ন প্লটে৷ সময়টা ২০১১ সাল। বাংলাদেশের কোচ তখন সাইফুল বারী টিটো। জামালের বেশকিছু ভিডিও দেখে তাঁকে ই-মেইল করে বাংলাদেশে ট্রায়ালের জন্য আসতে বলেন টিটো। জামালের বাবাও চেয়েছিল ছেলে দেশের ফুটবলের জন্য স্মরণীয় কিছু করুক৷ টিটোর ডাকে জামাল বাংলাদেশে আসলেন ট্রায়ালের জন্য। কিন্তু সময়টা মোটেও ভালো যায়নি তাঁর৷ ডেনমার্ক ছেড়ে বাংলাদেশে এসে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন৷ এখানকার ভাষা, আবহাওয়া, খাদ্য সবই ছিল জামালের বিপক্ষে। এসবের সাথে মানিয়ে নিতেই জামালের কেটে যায় অনেক দিন৷ শেষে হতাশ হয়ে ফিরে যান ডেনমার্কে৷
দু’বছর পর মোবাইল টুংটাং কলের শব্দ৷ ওপাশ থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ বললেন,‘তোমাকে আমার দলে নিতে চাই৷ চলে আসো।’ সায় দিয়ে চলে আসলেন জামাল।
২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট। ছয় বছর আগের ১৫ নভেম্বেরের গুলির ঘটনার মতো এ দিনটিও জামালের আজীবন মনে থাকবে৷ তবে দিনটি ছিল ভিন্ন, দেয়ালে খোদাই করার মতো৷ নেপালের বিপক্ষে সাফ চ্যাম্পিয়ন্সশিপ ম্যাচ দিয়ে লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষেক হয় জামালের৷ ম্যাচ শুরুর আগে কোচ ক্রুইফ জামালকে জানিয়ে দিলেন,‘তুমি শুরুর একাদশে থাকছো’। জবাবে জামাল বলেছিলেন, ‘মাত্রই তো এলাম, মানিয়ে নিতে সময় লাগবে’ কোচ ক্রুইফ কোনো কথা শুনলেন না, জামাল খেললেন শুরুর একাদশে৷
শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়৷ আয়েশী ইউরোপিয়ান জীবন ছেড়ে চলে এলেন দেশের ফুটবলে৷ সিনেম্যাটিক জীবনের মতো নানা উত্থান-পতন মাড়িয়ে আসা জামাল কালক্রমেই হয়ে ওঠেন দেশের ফুটবলের মধ্যমণি৷ দেশের ফুটবলের একমাত্র পোস্টারবয়৷
আরও পড়ুন: বিদেশি কোচে কেন ব্রাজিলের এত অনাগ্রহ?
ক্রিফোস্পোর্টস/৭ফেব্রুয়ারি২৪/টিএইচ/এমটি