মিটমিট থেকে কখনো জ্বলজ্বল। ঘন মেঘের আস্তরণ ভেদ করে এভাবেই নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় আকাশের তারারা৷ অন্ধকারে আকাশের সৌন্দর্য্য এ তারারা-ই৷ চাঁদের পাশে তাদেরও যে বড্ড মানায়৷ দুই দশক আগে স্যান্তিয়াগো বার্নাব্যু’র শ্বেত উপত্যকায় বসে ফুটবলের সমসাময়িক তারাদের মেলা৷ ফুটবলে জন্ম নেওয়া নামকরা তারকাদের একে একে দলে বেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ৷ সঙ্গত কারণেই দলটি তখন পরিচিত হয়ে ওঠে ‘গ্যালাক্টিকো’ নামে৷ রিয়াল মাদ্রিদের ‘গ্যালাক্টিকো’ নামের তারার হাট
স্পেনিশ এ শব্দের রয়েছে নিজস্ব মাহাত্ম্য। ‘গ্যালক্টিকো’ শব্দের বাংলা তরজমা মহাতারকা। ইংরেজীতে যা সুপারস্টার। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, অমাবস্যার গুমোট অন্ধকার ছিড়ে আকাশে জ্বলজ্বল করা তারা। সমসাময়িক ফুটবলের প্রতিভাবান তারকাদের দলে ভেড়ানোর কারণেই রিয়াল মাদ্রিদের নামের পাশে জুড়ে যায় ‘গ্যালাক্টিকো’ নাম৷
রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সফলতম প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের আমলে জনপ্রিয়তা পায় গ্যালাক্টিকো নামটি৷ অবশ্য এর মূলে রয়েছে কাড়িকাড়ি অর্থের ঝনঝনানি। ৯০ দশকে বার্সেলোনা যখন ক্রুইফের অধীনে রোমারিও, গার্দিওলা, স্টোইচকভ ও লুড্রপকে নিয়ে গড়েছে দুর্ধর্ষ ‘ড্রিম টিম’, ঠিক সেসময় রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ৷ ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২টি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতেও নিজের প্রেসিডেন্ট পদটি রক্ষা করতে পারেননি লরেঞ্জো সাঞ্জো৷ পেরেজের এক প্রতিশ্রুতির কাছে হারতে হয় তাঁকে৷ কি সেই প্রতিশ্রুতি?
ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেই বার্সেলোনা থেকে উড়িয়ে আনা হবে লুইস ফিগোকে৷ নির্বাচনে জয়ের মূলে ছিল এই প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনে জিতে লুইস ফিগোকে দিয়ে গ্যালাক্টিকোর প্রথম অধ্যায় শুরু করেন পেরেজ৷ ২০০০ সালে বার্সেলোনা থেকে ৬২ মিলিয়নে লুইস ফিগোকে দলে বেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ।
রিয়ালের তৎকালীন ট্রেনিং গ্রাউন্ডটি প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করে পেরেজ এবার মনযোগ দেন দল গঠনের দিকে৷ ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সেই অর্থ দিয়ে জিনেদিন জিদান, রোনালদো নাজারিও, ডেভিড বেকহাম, রবিনহো, মাইকেল ওয়েন ও সার্জিও রামোসের মতো তারকাদের দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। পূর্বে থেকেই দলে ছিলেন ক্যাসিয়াস, রবার্তো কার্লোস আর রাউল গঞ্জালেসরা। এ যেন তারার হাট। তারকায় ঠাসা সান্তিয়াগো বার্নাব্যু৷
২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালের ৪৫ মিনিটে এক স্মরণীয় কীর্তি গাঁথেন গ্যালাক্টিকোদের জিদান৷ ম্যাচের ৮ মিনিটে রাউলের গোলে এগিয়ে যাওয়া রিয়ালকে বেশিক্ষণ স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি বেয়ার লেভারকুসেন। ১৪ মিনিটেই লুসিও’র গোলে সমতায় ফেরে লেভারকুসেন। এরপর ম্যাচের ৪৫ মিনিটে জিনেদিন জিদানের সেই বিখ্যাত ভলি গোলে এগিয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। এ গোলেই নিজেদের নবম চ্যাম্পিয়ন্স লীগটি জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। ঐসময় তিন মৌসুমে তৎকালীন কোচ দেল বস্কের অধীনে দুটি ঘরোয়া লীগ ও একটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু তাতেও মন ভরেনি পেরেজের৷ বরখাস্ত করা হয় দেল বস্ককে৷ এতে শুরু হয় গ্যালাক্টিকোর ছন্দপতন।
পেরেজের জনপ্রিয়তাও ভাটা পড়তে শুরু করে। দেল বস্কের পরিবর্তে ডাগআউটে দাঁড়ায় অনভিজ্ঞ কুইরোজ৷ কিন্তু দেল বস্কের মতো তারকাঠাসা রিয়ালকে সামলাতে পারেননি তিনি৷ ২০০৪-০৫ মৌসুমে ট্রফিহীন সময় কাটে তাদের। সেই সঙ্গে রিয়ালকে বিদায় বলে দেন লুইস ফিগো৷ পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শেষ ষোলোতে আর্সেনালের কাছে হেরে রিয়ালের বিদায়ের সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ৷ সেই বছর রোনালদো নাজারিও দল ছেড়ে দেন, জিদান চলে যান অবসরে৷ ২০০৭ সালে বেকহামের বিদায়ের মাধ্যমে গ্যালাক্টিকোর প্রথম অধ্যায়ের ইতি ঘটে।
পেপ গার্দিওলার অধীনে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়োল, আলভেজরা তখন রীতিমতো ইউরোপে উড়ছিল৷ সর্বজয়ী এই বার্সার বিপরীতে রিয়াল তখন নিয়মিত ধুঁকছিল৷ ২০০৮-৯ মৌসুমে লা-লিগা হারানোর পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শেষ ষোল থেকে টানা পঞ্চম বার ছিটকে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। ওই মৌসুমে কেবল রিয়াল মাদ্রিদের ট্রফি ক্যাবিনেটে যোগ হয় সুপারকোপা৷ অন্যদিকে বার্সেলোনার কাছে হারতে হয় ৬-২ গোলের বড় ব্যবধানে৷ এতে বিষণ্ন মনে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেন তৎকালীন রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ক্যালদেরন৷
হারতে হারতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া রিয়াল মাদ্রিদকে জয়ের দিশা দেখান সেই ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ৷ পুনর্জাগরণের কেতন নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাজির হন পেরেজ৷ ডিফেন্স-মিডফিল্ড কিংবা আক্রমণভাগ– সবখানেই শক্তিশালী দুর্গ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনেও জিতে যান ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ৷ শুরু হয় গ্যালাক্টিকো সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব।
২০০৯ সালে একযোগে এসি মিলান থেকে কাকা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিভারপুল থেকে জাভি আলোন্সো ও লিওন থেকে করিম বেনজেমাকে দলে ভিড়িয়ে ফুটবল বিশ্বকে চমকে দেয় পেরেজ৷ যেখানে সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ যেন মহাবিশ্বের সেই বৃহত্তম তারা ‘ইউ ওয়াই স্কিউটি’ নিয়ে আসলেন৷ যার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয় গ্যালাক্টিকোদের দ্বিতীয় পর্বের মঞ্চ।
মাত্র এক বছর পর স্যান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যোগ দেয় ডি মারিয়া ও জার্মানির মেসুত ওজিল৷ প্রথম মৌসুমে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য না পেলেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে আসা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো হন রিয়ালের সর্বোচ্চ গোলদাতা৷ কিন্তু সাফল্য না আসার খেসারত দিতে হয় তৎকালীন কোচ পেল্লেগ্রিনিকে৷ তাঁকে বরখাস্ত করে ডাগআউটে নিয়ে আসা হয় ‘দ্যা স্পেশাল ওয়ান’ জোসে মরিনহোকে। ইন্টার মিলানকে ট্রেবল জিতেয়ে ইতোমধ্যেই তিনি নিজেই গ্যালাক্টিকো৷ মরিনহো আসার পর একে একে রিয়ালে যোগ দেয় লুকা মদ্রিচ, ইস্কো, গ্যারেথ বেল ও টনি ক্রুস।
গার্দিওয়ালার টিকিটাকার সামনে মরিনহো আসেন ৪-২-৩-১ কৌশল নিয়ে৷ তখনকার অপ্রতিরোধ্য বার্সেলোনাকে তিন মৌসুম পর নূ-ক্যাম্পে হারানো, কোপা দেল রের ফাইনালে হারানো ও সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে লীগে। ১২১ গোল আর ১০০ পয়েন্ট রেকর্ড নিয়ে নিজেদের লীগ উদ্ধার করে রিয়াল মাদ্রিদ৷ মরিনহো বনে যান রিয়াল মাদ্রিদের গ্যালাক্টিকো সিরিজের দ্বিতীয় পর্বের নায়ক।
আরও পড়ুন: ফুটসাল ফুটবল খেলার নিয়ম কি? কীভাবে খেলে?
ক্রিফোস্পোর্টস/৭মে২৪/টিএইচ/এসএ