ফুটবল বিশ্বে ‘জোগো বোনিতো’ বা সুন্দর ফুটবলের কথা উঠলেই সবার আগে যে দেশের নাম মুখে আসবে সেটা ব্রাজিল। পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের এই সুন্দর ফুটবলের ধারক ও বাহক হিসেবে বিশ্ব জুড়ে সুখ্যাতি রয়েছে। ব্রাজিলের পেলে, জিকো, সক্রেটিস, গারিঞ্চা, রিভালদো, রোমারিও, রোনালদো থেকে রোনালদিনহোরা যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী শৈল্পিক ফুটবলের মুগ্ধতা ছড়িয়ে আচ্ছন্ন করেছে কোটি কোটি ফুটবল ভক্তদের।
অথচ সেই ব্রাজিল এখন ফুটবল বিশ্বে ধুঁকতে থাকা এক জাতির নাম। বর্তমান ব্রাজিলের ফুটবল দেখে এখন আর ভক্তরা মোহে আচ্ছন্ন হন না, বরং আফসোসে ফেটে পড়ার জো হয় তাদের। বর্তমান দলের একমাত্র ভরসা নেইমারকে ছাড়া বর্তমান ব্রাজিল একেবারেই যেন অসহায়। খেলায় এখন আর আগের সেই জৌলুস চোখে পড়ে না। যার সবশেষ উদাহরণ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে আসর থেকে ব্রাজিলের বিদায় নেয়ার ম্যাচটি।
২২ বছর আগে বিশ্বকাপ আর ৫ বছর আগে সবশেষ কোন শিরোপা জেতা ব্রাজিলের বর্তমান এই ধ্বজভঙ্গ অবস্থার সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক –
অর্থের লোভে তরুণ ফুটবলারদের বিদেশ পাড়ি –
সবচেয়ে সেরা ফুটবল জাতি হিসেবে ব্রাজিলের নাম-ডাক বেশ পুরোনো। এমনিতে তো আর একমাত্র দেশ হিসেবে পাঁচটি ফুটবল বিশ্বকাপ ঘরে তোলেনি তারা! কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ব্রাজিলের তরুণদের বেশ কম বয়সেই অর্থের লোভে বিদেশে পাড়ি দেয়া আগের চেয়ে বেড়েছে। আর এর সবচেয়ে বড় দায় ইউরোপীয় ক্লাবগুলির। তারা সম্ভাবনাময়ী তরুণদের খোঁজ পাওয়া মাত্রই অর্থের ঝুলি নিয়ে হাজির হচ্ছেন ক্লাবগুলোর কাছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ। গেল কয়েক বছরে ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, এন্ড্রিকের মত তরুণদের ক্লাবে ভিড়িয়েছে তারা। প্রথম দু’জন রিয়ালে নিজেদের জায়গাও প্রায় পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। এবার পেলের পর একমাত্র ব্রাজিলিয়ান হিসেবে ১৮ বছরের আগে টানা তিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করা এন্ড্রিকের পালা রিয়ালে জায়গা পাকাপোক্ত করার। তবে ক্লাবে আলো ছড়ালেও জাতীয় দলে এখনও নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন ভিনি, রদ্রিগোরা। আর এন্ড্রিক তো উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিটে সফল পাসই দিয়েছেন মাত্র ১ টি। ফলে ব্রাজিলও খেলছে ছন্নছাড়া ফুটবল।
আরো পড়ুন : উইম্বলডনে ঘটল নজিরবিহীন ঘটনা, কী করলেন নোভাক জোকোভিচ?
সুন্দর ফুটবল থেকে সরে আসা –
শৈল্পিক ফুটবলের ছোঁয়া আমরা যে অঞ্চলের খেলায় পেয়ে থাকি সেটা লাতিন আমেরিকা। আর লাতিন দলগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে সবার শীর্ষে থাকে ব্রাজিল। কিন্তু দেশটির বেশির ভাগ খেলোয়াড় বিদেশি গিয়ে খেলায় জাতীয় দলে তাদের খেলায় সেই ‘জোগো বোনিতো’র অভাব লক্ষ্যনীয়। কেননা ইউরোপের ফুটবল অনেক বেশি কৌশলগত। তাই যারা ইউরোপে খেলে তারা জাতীয় দলে গিয়ে দেশীয় কোচদের পরিকল্পনায় দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। লাতিন আমেরিকায় খেলার ধরণও ইউরোপের মত অতটা কৌশলগত নয়। এতে ফুটবলে নিজেদের স্বাভাবিক শিল্প হারাতে বসেছে সেলেসাওরা। অনায়াসে কয়েকজনকে বল নিয়ে কাটিয়ে যাওয়া, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানো ক্রমেই ব্রাজিলের ফুটবল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিলের ফুটবল ঐতিহাসিকরা তো দেশের ফুটবলের স্বকীয়তা হারানো নিয়ে শঙ্কাই প্রকাশ করেছেন।
সঠিক মানের কোচের অভাব –
ব্রাজিল দলের কোচিং নিয়েও প্রতিবারই প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। গেল ২০২২ বিশ্বকাপে তিতের পর কোচের পদে তিন জন নতুন মুখ দেখেছে ব্রাজিল দল যার সবশেষ সংযোজন দরিভাল জুনিয়র। তার সঙ্গে দলের বনিবনা খুব ভালো কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি কোপা আমেরিকা চলাকালীন ইন্টারনেটে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দলের সব খেলোয়াড়েরা কোচকে ছাড়াই ‘টিম হাডল’ এ অংশ নিয়েছে আর দরিভাল পাশ থেকে সেখানে উঁকিঝুঁকি মারছেন। টিম হাডলে এমন ঘটনা কিছুটা বিরল।
আবার সিবিএফ এ অলিখিত নিয়ম যে, তারা ব্রাজিলিয়ান ছাড়া বিদেশি কোন কোচকে ব্রাজিল দলের দায়িত্বে আনতে চায় না৷ এটাও তাদের পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ। কেননা দেশীয় কোচদের নেয়া হয় ঘরোয়া লিগে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কারো মধ্য থেকে। আর ইউরোপীয় কোচিংয়ে যে পরিমাণ বদল বা বিপ্লব চলছে তার সঙ্গে দেশীয় কোচদের পক্ষে টেক্কা দেয়াটা খুবই কঠিন। অনেকে নিজের টাকায় ইউরোপে গিয়ে কোচিং শিখলেও অর্থাভাবে সপটা সবার জন্য সম্ভবপর নয়। এছাড়াও ইউরোপীয় ধাঁচের অনুশীলন, প্রযুক্তির ব্যবহার ও অন্যান্য বিষয়েও দেশীয় কোচরা পিছিয়ে থাকেন। ফলে ক্লাবে ভিনি, রদ্রিগোরা আলো ছড়ালেও জাতীয় দলের কোচের পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খেয়ে যান।
ঘরোয়া লিগের খারাপ মান –
ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগের খারাপ মানের অন্যতম কারণ তাদের তরুণ তারকারা ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর নজরে পড়া মাত্রই ফুটবলারদের নিজেদের ডেরায় নিয়ে যায় ক্লাবগুলো। এতে খেলোয়াড়দের মানের দিক দিয়ে ইউরোপীয়রা ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু লাতিন অঞ্চলের সেই হিসেবে দৃশ্যমান উন্নতি চোখে পড়ছে না। এরপরও লাতিন আমেরিকার ক্লাব ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের আসরে শেষ পাঁচ বারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব। এরপরও তারা ইউরোপের চেয়ে ঢের পিছিয়ে আছে। সবশেষ ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেন্সকে ৪-০ তে উড়িয়ে দিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। এ থেকেই দুই অঞ্চলের ফুটবলের মানের পার্থক্য স্পষ্ট সমর্থকদের কাছে। আর একটি দেশের খেলার মানের উন্নতিও অনেকটাই নির্ভর করে সে দেশের ঘরোয়া লিগের মানের উপর। যার প্রভাব আমরা আফ্রিকা ও এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর দিকে তাকালে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবো। ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগও তার আগের জৌলুস ধরে রাখতে পারেনি, মানের অবনতি হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে জাতীয় দলেও।
তবে অনেকেরই বিশ্বাস সেলেসাওদের চলমান এই দুঃসময় ক্ষণ স্থায়ী, অতি দ্রুতই আবারও সোনালী সময় ফিরে আসবে ব্রাজিলের ফুটবলে।
ক্রিফোস্পোর্টস/৯জুলাই২৪/এমএস