ক্রিকেট মাঠে আলোচিত সিদ্ধান্তের তালিকা দীর্ঘ। তবে সাম্প্রতিক বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির চতুর্থ টেস্টে তৃতীয় আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা সৈকতের একটি সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (MCG) অনুষ্ঠিত ম্যাচে ভারতের ওপেনার ইয়াশস্বী জয়সওয়ালকে আউট ঘোষণা করা নিয়ে তৈরি হয় তীব্র বিতর্ক।
মাঠের আম্পায়ার জোয়েল উইলসন যখন জয়সওয়ালকে নটআউট ঘোষণা করেন, অস্ট্রেলিয়া দল সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নেয়। স্নিকোমিটারে স্পাইক না থাকা সত্ত্বেও সৈকত একটি ডিফ্লেকশন দেখেন এবং মাঠের সিদ্ধান্ত বদলে দেন। এই আউট ভারতের ড্র করার সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। সৈকতের এই সিদ্ধান্ত তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
পর্দায় যে শরফুদ্দৌলা সৈকতকে আম্পায়ারের পোশাকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন দক্ষ বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে। তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ একটি টুর্নামেন্ট।
আরও পড়ুন :
» আইসিসির বর্ষসেরা পুরস্কার উঠছে কার হাতে
» ওভার রেট বাড়াতে এসে জয়ের নায়ক ট্রাভিস হেড
» ম্যানইউ ছাড়ছেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার ক্যাসেমিরো
আইসিসি ট্রফিতে সৈকত তিনটি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন এবং ছয়টি উইকেট শিকার করেন। তার গড় ছিল ১৮.৬৬ এবং ইকোনমি রেট ছিল ৪.১৭। তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ারও ছিল উল্লেখযোগ্য। ১০ ম্যাচে তিনি ৩১টি উইকেট নেন, যেখানে দুটি পাঁচ উইকেট শিকার তার দক্ষতার সাক্ষী।
তবে খেলোয়াড় হিসেবে দীর্ঘ সময় মাঠে থাকার সুযোগ না পেলেও ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে নিয়ে আসে আম্পায়ারিংয়ে।
শরফুদ্দৌলা সৈকতের আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার শুরু হয় ধীরগতিতে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার আম্পায়ারিং পরিসংখ্যান নজরকাড়া। তিনি ১৫টি টেস্ট, ৬৩টি ওয়ানডে, এবং ৫২টি টি-টোয়েন্টিতে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি তিনি ১৩টি মহিলা ওয়ানডে এবং ২৮টি মহিলা টি-টোয়েন্টিতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০২৩ সালে তিনি নারী অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপেও আম্পায়ারিং করেন। তার এই ক্যারিয়ার তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্যতম দক্ষ আম্পায়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
২০২৪ সালে তিনি মারাইস এরাসমাসের জায়গায় আইসিসি এলিট প্যানেলে জায়গা করে নিয়ে ইতিহাস গড়েন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ প্যানেলে স্থান পেয়েছেন। এটি শুধুমাত্র তার দক্ষতারই স্বীকৃতি নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য গর্বেরও বিষয়।
শরফুদ্দৌলা সৈকতের পেশাদার ক্যারিয়ার যতটা সফল, তার ব্যক্তিগত জীবনও ততটাই সমৃদ্ধ। তিনি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় (HRM) এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। তার এই অ্যাকাডেমিক অর্জন তাকে একটি বহুমুখী ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
ইয়াশস্বী জয়সওয়ালের আউট নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক নতুন নয়। স্নিকোমিটারের প্রযুক্তি ব্যবহার সত্ত্বেও সৈকত কেন শুধু ডিফ্লেকশনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত দিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাবেক ভারতীয় ব্যাটার সুনীল গাভাস্কার এই সিদ্ধান্তকে “অপটিক্যাল ইলিউশন” বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এটি হয়তো মাঠের বাস্তবতা বোঝার ভুল ছিল।
অন্যদিকে, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে সৈকত তার অভিজ্ঞতা ও খেলার নিয়ম অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রযুক্তি এবং বাস্তবতার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা অনেক সময় আম্পায়ারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।
বিতর্কিত সিদ্ধান্তের মধ্যেও তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত। ভবিষ্যতে তার মতো আরও বাংলাদেশি আম্পায়াররা বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবেন, এটাই টাইগার সমর্থকদের প্রত্যাশা।
ক্রিফোস্পোর্টস/৩১ডিসেম্বর২০২৪/আইএইচআর/এসএ