ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার হিসেবে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তিনি হলেন স্যার গারফিল্ড সেন্ট অব্রান সোবার্স, যিনি সাধারণত গ্যারি সোবার্স নামে পরিচিত। ক্রিকেটে তার অবিশ্বাস্য প্রতিভা এবং অবদান তাকে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের তালিকায় শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে। তার ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং দক্ষতার কারণে তিনি ক্রিকেট বিশ্বে অনন্য পরিচিতি পেয়েছেন।
গারফিল্ড সোবার্সের জন্ম ২৮ জুলাই ১৯৩৬ সালে, বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে। তিনি আট ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম সন্তান। শৈশবে তিনি অত্যন্ত কৌতূহলী এবং সাহসী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ দেখা যায়।
তবে শৈশবেই তাকে একটি বড় ধাক্কা সামলাতে হয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা মিডলটন অগাস্টাস সোবার্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ মেরিন বাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে মারা যান। বাবার মৃত্যু তার পরিবারের জন্য বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছিল, তবে সেই কষ্টই তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
আরও পড়ুন :
» রোজারিও থেকে যেভাবে ‘ফুটবল জাদুকর’ লিওনেল মেসি
» বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেমন ছিল তামিম ইকবাল ‘অধ্যায়’
» পাঠ্যবইয়ে নাম আসায় উচ্ছ্বসিত জ্যোতি ও তার পরিবার
গ্যারি সোবার্সের ক্রিকেট প্রতিভা তার শৈশবেই প্রকাশ পায়। তিনি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতেন, তবে ক্রিকেট ছিল তার প্রধান আগ্রহের বিষয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে, ১৯৫৩ সালে বার্বাডোস ক্রিকেট দলের হয়ে তার প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়। তার অসাধারণ দক্ষতা এবং ধৈর্য তাকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে।
১৯৫৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে গ্যারি সোবার্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়।প্রথম দিকে তিনি মূলত বোলার হিসেবে খেলতেন কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার ব্যাটিং দক্ষতা দেখাতে শুরু করেন। খুব দ্রুত দলের অন্যতম প্রধান ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেন।
গ্যারি সোবার্সের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব—তার অলরাউন্ড দক্ষতা। তিনি শুধু একজন দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানই নন, বরং একজন অসাধারণ বোলার এবং ফিল্ডারও ছিলেন। তার ব্যাটিং স্টাইল ছিল ধৈর্যশীল। তিনি বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন এবং বিভিন্ন ধরনের বোলিং স্টাইল আয়ত্ত করেছিলেন, যেমন – বাঁহাতি স্পিন, মিডিয়াম পেস এবং ফাস্ট বোলিং। তার বোলিং দক্ষতা তাকে দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক টেস্ট ম্যাচে গ্যারি সোবার্স তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন। তবে এটি ছিল কেবল সেঞ্চুরি নয় – তিনি সেই ইনিংসে ৩৬৫ রান করেন এবং অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন। এই ইনিংসটি সেই সময়ের টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড স্থাপন করে, যা ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অটুট ছিল। এই ইনিংস তাকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে তোলে এবং বিশ্ব ক্রিকেটে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।
গ্যারি সোবার্স শুধু দক্ষ ক্রিকেটারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ নেতা। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক হিসেবে ৩৯টি টেস্ট ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার অধিনায়কত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অনেক বড় সাফল্য অর্জন করেছে। তার নেতৃত্বে দল আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে খেলত এবং প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করতে পারত। গ্যারি সোবার্সের ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান তাকে অলরাউন্ডারের কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
টেস্ট ক্রিকেটে গ্যারি সোবার্সের ব্যাটিং পরিসংখ্যান
- ম্যাচ – ৯৩
- রান – ৮,০৩২
- সেঞ্চুরি – ২৬
- হাফ-সেঞ্চুরি – ৩০
- ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ – ৩৬৫ (অপরাজিত)
গ্যারি সোবার্স ফিল্ডার হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন। তার তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া এবং নিখুঁত ক্যাচিং দক্ষতা তাকে এক অনন্য ফিল্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার ক্যারিয়ারে তিনি ১০৯টি ক্যাচ ধরেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে গ্যারি সোবার্সের বোলিং পরিসংখ্যান
- উইকেট – ২৩৫
- সেরা বোলিং ফিগার – ৬/৭৩
গ্যারি সোবার্সের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত সরল। তিনি সবসময় পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি বিয়ে করেন প্রুডেন্স ড্যান্সার নামে এক অস্ট্রেলিয়ান নারীকে। তাদের তিন সন্তান রয়েছে।
সোবার্স ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি কোচিং এবং উপদেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন।
গ্যারি সোবার্সের সম্মাননা
- ১৯৭৫ সালে নাইটহুড প্রদান করা হয় এবং তিনি স্যার উপাধি লাভ করেন।
- ২০০০ সালে, আইসিসি ক্রিকেট হল অফ ফেম-এ অন্তর্ভুক্ত হন।
- বার্বাডোস সরকার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি চালু করে, যা প্রতিবছর সেরা ক্রিকেটারকে দেওয়া হয়।
স্যার গারফিল্ড সোবার্স শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্ব নন, তিনি ক্রিকেট বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। তার অসাধারণ পারফরম্যান্স এবং নেতৃত্বগুণ তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তার জীবন শেখার– পরিশ্রম, প্রতিভা ও সাহস যে কাউকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।
ক্রিফোস্পোর্টস/১১জানুয়ারি২০২৫/আইএইচআর/এসএ