বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য সবচেয়ে প্রতীক্ষিত একটি টুর্নামেন্ট। প্রতিবছরই নতুন উত্তেজনা, চমক এবং তারকাদের পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এবারের আসর কিছুটা ভিন্ন কারণ এবং পরিস্থিতির জন্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
২০২৪ সালের বিপিএলে থাকছেন না দেশের দুই সেরা ও সফলতম ক্রিকেটার—মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং সাকিব আল হাসান। এ ছাড়াও বেশ কিছু বিদেশি তারকার অনুপস্থিতি এবারের আসরের পরিবেশকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তবে শিরোপার লড়াইয়ে দলগুলোর প্রস্তুতি, প্রত্যাশা এবং তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নতুন রঙ যোগ করেছে।
বিপিএল শুরু হওয়ার আগে থেকেই মাশরাফি এবং সাকিবের অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক চলছিল। একদিকে, দেশের ক্রিকেটে এই দুই তারকার অসামান্য অবদান। মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহিরুহ, পাঁচবারের বিপিএল চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক এবং দেশের ক্রিকেটে উন্নয়নের অন্যতম পথিকৃত। অন্যদিকে, সাকিব আল হাসান শুধু দেশের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। তিনি বিপিএলে চারবারের সেরা পারফরমার হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।
তবে, সম্প্রতি রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ দেখা দেয়। জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এই দুই তারকার নিরবতা এবং মাশরাফির সংসদ সদস্য হিসেবে ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। সচেতন মহলের মতে, এই পরিস্থিতিতে বিপিএলে তাদের অংশগ্রহণ আরও উত্তেজনা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারত। তাই এবারের বিপিএলে তাদের খেলতে দেখা যাচ্ছে না। একটি পক্ষের মতে, দেশের ক্রিকেটে এত বড় অবদান থাকা সত্ত্বেও ঘরের মাঠে খেলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। অন্যদিকে, আরেক পক্ষের মত, তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক আচরণ বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত সঠিক।
শুধু মাশরাফি ও সাকিবই নয়, এবারের আসরে বেশ কিছু বড় নামের বিদেশি ক্রিকেটারও অনুপস্থিত। আন্দ্রে রাসেল, সুনিল নারিন, নিকোলাস পুরান, ইমরান তাহির, জিমি নিশাম, বাবর আজম এবং মোহাম্মদ রিজওয়ানের মতো তারকারা এবার বিপিএলে নেই। তাদের অনুপস্থিতি টুর্নামেন্টের আকর্ষণ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।
তবে পাকিস্তানের তারকা ফাস্ট বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি এবং ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান জেসন রয়ের মতো খেলোয়াড়রা বিপিএলে যোগ দিয়ে উত্তেজনা বাড়াচ্ছেন। শাহিন প্রথমবারের মতো ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলতে মাঠে নামবেন, যা ভক্তদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
আরও পড়ুন:
» নীতিশ কুমার রেড্ডি: প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন
» তরুণ ব্রাজিলিয়ানের প্রথম গোলে জয়ের ধারায় ম্যানসিটি
বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিপিএল শুধু একটি টুর্নামেন্ট নয়, বরং এটি তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য নিজেদের প্রমাণের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। এবারের আসরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বিপিএলকে, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্পিরিট ধরে রাখতে তারুণ্যের উৎসবে পরিণত করতে চায়। ফলে এবারের আসরের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য।
বিপিএলে অংশ নেওয়া সাতটি দলই শিরোপার জন্য মরিয়া। প্রতিটি দলের খেলোয়াড়, কোচ এবং অধিনায়ক নিজেদের সেরা প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি এবং খেলোয়াড়দের কথোপকথন থেকে তাদের প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ফরচুন বরিশাল (তামিম ইকবাল)
ফরচুন বরিশালের অধিনায়ক তামিম ইকবাল জানালেন, তারা শিরোপা ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামবেন। গত মৌসুমে বরিশাল কাগজে-কলমে তৃতীয় শক্তিশালী দল হলেও নিজেদের পারফরম্যান্স দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তামিম বলেন, ‘এবারও আমরা ভালো করার জন্য প্রস্তুত। শুরুর ম্যাচগুলো থেকে বোঝা যাবে কোন দল টাইটেলের জন্য লড়বে।’
ঢাকা ক্যাপিটালস (থিসারা পেরেরা)
ঢাকা ক্যাপিটালসের তারকা খেলোয়াড় থিসারা পেরেরা বিপিএলকে সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর বিপিএল আরও ভালো হচ্ছে। এমন ধারাবাহিক টুর্নামেন্টে খেলা সবসময়ই আনন্দদায়ক। আমরা শিরোপা জয়ের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
দুর্বার রাজশাহী (ইজাজ আহমেদ)
দুর্বার রাজশাহীর প্রধান কোচ ইজাজ আহমেদ তরুণ এবং অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী দল গড়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দলে ইয়াসির, তাসকিন এবং এনামুল হকের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় রয়েছেন। হারিস রউফ এবং রায়ান বার্লের মতো বিদেশি তারকারাও দলে যোগ দিয়েছেন। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, ভালো কিছু করতে পারব।’
রংপুর রাইডার্স (কাজী নুরুল হাসান সোহান)
রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক সোহান দলের অলরাউন্ডারদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দলে ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং—তিন বিভাগেই ভারসাম্য রয়েছে। আমরা শিরোপার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত।’
খুলনা টাইগার্স (আফিফ হোসেন)
খুলনা টাইগার্সের তরুণ খেলোয়াড় আফিফ হোসেন বিপিএলকে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘বিপিএল প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভালো করলে শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নয়, বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলার সুযোগ পাওয়া যায়।’
সিলেট স্ট্রাইকার্স (জর্জ মানজি)
স্কটিশ ক্রিকেটার জর্জ মানজি সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে খেলবেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমার প্রথমবার বাংলাদেশে খেলা। আমি নিজেকে মেলে ধরার এবং নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করব।’
চিটাগং কিংস (মোহাম্মদ মিঠুন)
চিটাগং কিংসের অধিনায়ক মোহাম্মদ মিঠুন জানান, তাদের দলটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমরা সাকিবকে মিস করব, তবে আমাদের দল যথেষ্ট শক্তিশালী। শিরোপা জয়ের জন্য আমরা মাঠে সেরা পারফরম্যান্স দিতে প্রস্তুত।’
২০২৪ সালের বিপিএল কিছুটা ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও এর উত্তেজনা ও আকর্ষণ অটুট রয়েছে। মাশরাফি ও সাকিবের অনুপস্থিতি, কিছু বিদেশি তারকার না থাকা এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আয়োজিত এই আসর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় চিহ্নিত করবে। দলগুলোর প্রস্তুতি, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস এবং প্রতিযোগিতার আকর্ষণ সব মিলিয়ে এবারের বিপিএল ভিন্নমাত্রায় আলোচিত হতে পারে।
এবারের আসরে শিরোপা জয়ের লড়াই যেমন হাড্ডাহাড্ডি হবে বলে আশা করা যায়, তেমনি তরুণ খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সও নতুন তারকা জন্ম দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত মাঠে পারফরম্যান্স এবং টুর্নামেন্টের সংগঠনই নির্ধারণ করবে বিপিএল কতটা সফল হয়।
ক্রিফোস্পোর্টস/৩০ডিসেম্বর২৪/আইআর/এফএএস