জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও—ফুটবল যৌবন পেয়েছে ব্রাজিলে। ফুটবলটাকে ব্রাজিলিয়ানরা জীবনের ছন্দে রূপান্তরিত করেছে। অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে এই খেলাটাকে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে বেড়ে ওঠে সেখানকার একটি প্রজন্ম৷ ফুটবলের প্রতি ব্রাজিলিয়ানদের আবেগ আমাজন নদীর নিরন্তর ধেয়ে চলা স্রোতের মতো, যার কোনো উপসংহার নেই৷
ছন্দময় ফুটবলের দেশ নামে খ্যাত ব্রাজিল থেকে যুগে যুগে ফুটবলের ঝান্ডা উড়িয়েছে পেলে, গ্যারিঞ্চা, সক্রেটিস, জিকো, কাফু, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদিনহো থেকে বর্তমান প্রজন্মের নেইমার, থিয়াগো সিলভা৷ ফুটবলের প্রতি তাদের আবেগ চিরন্তন৷
হলুদ জার্সি গায়ে সবুজ ঘাসে বল পায়ে নানন্দিক সব কারুকাজ ফুটিয়ে তুলেন ব্রাজিলিয়ানরা। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো একবার বলেছিলেন—‘ব্রাজিলিয়ানদের জন্য এই হলুদ জার্সিটা পবিত্র। যখন আমরা এটি গায়ে চাপাই, অবশ্যই গর্ব অনুভব করি। একই সঙ্গে তা দায়িত্ববোধও নিয়ে আসে। এটা সবাইকে অনুপ্রাণিত করে এবং রোমাঞ্চে ভাসিয়ে দেয়।’
আরও পড়ুন :
» ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ গোলের মুকুট রোনালদোর, সেরা চারে আর যারা
» শনির দশা লেগেই আছে ব্রাজিল ফুটবলে, ফের ফিফার চিঠি
যেভাবে রঙিন হয় ‘সেলেসাও’ শব্দটি
ফুটবল আঙিনায় ব্রাজিলকে ডাকা হয় সেলেসাও নামে৷ কিন্তু কিভাবে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের রঙে রঙিন হয় সেলেসাও শব্দটি? কিভাবে উত্থান হয় ব্রাজিলের নামের পাশে ‘সেলেসাও’?
একটা সময় ফুটবলের জার্সিধারী ব্রাজিল ছিল বর্তমান পর্তুগালের উপনিবেশ। ১৮২২ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে ব্রাজিল স্বাধীনতা পেলেও দেশটির ভাষা, সংস্কৃতিতে আজও মিশে আছে পর্তুগিজরা৷ সে সময় এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অভিবাসী, আফ্রিকান, পর্তুগিজ সংস্কৃতি একত্রে আজকের আধুনিক ব্রাজিলীয় জীবনধারা গঠন করেছে।
পুরো দক্ষিণ আমেরিকা যখন ছিল স্পেনের অধীনে, তখন একমাত্র ব্রাজিল ছিল পর্তুগালের অধীনে। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র পর্তুগিজ ভাষী দেশ হিসেবে পরিচিত ব্রাজিল। যাদের আচার-আচরণ থেকে শুরু করে সংস্কৃতিতেও মিশে আছে পর্তুগিজ ভাবধারা। তাই পর্তুগিজ ভাষায় ব্রাজিলকে বলা হয় ‘ব্রাসিল’।
ব্রাজিলের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী পর্তুগিজ ভাষাভাষী হওয়ায় তাদের সর্বত্র পর্তুগিজ ভাষা ও সংস্কৃতির জয়কার৷ ব্যতিক্রম নয় ফুটবলও৷ পর্তুগিজ ভাষার শব্দ ‘সেলেসাও’ অর্থ নির্বাচিত দল। এ শব্দ থেকেই ব্রাজিল ফুটবলের নামের পাশে উত্থান হয় ‘সেলেসাও’।
ব্রাজিল ফুটবল দলকে আরও যেসব নামে ডাকা হতো
শুধু সেলেসাও নয়, একসময় ব্রাজিল ফুটবল দল ক্যানারিনহা, ভার্দে আমারেলা নামেও পরিচিত ছিল৷ ১৯৫০-এর দশকে ব্রাজিল ফুটবল দলকে ডাকা হতো ক্যানারিনহা। যার অর্থ হলদে। ব্রাজিলের একটি বিখ্যাত প্রজাতির হলুদ পাখির নাম ছিল ক্যানারিনহো৷ সেই নাম থেকেই বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান কার্টুনিস্ট ফার্নান্দো পিরুচেত্তি ব্রাজিল ফুটবল দলের সঙ্গে ক্যানারিনহো নামটি জনপ্রিয় করে তোলেন৷ তখন থেকে ওই নামের অর্থের সঙ্গে মিল রেখে হলুদ রঙের জার্সি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের জন্য চূড়ান্ত করা হয়৷ মজার বিষয় হলো, এই জার্সি পরেই ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল।
১৯১৬ সালে দক্ষিণ আমেরিকা আঞ্চলিক ফুটবল সংস্থা কনমেবল ও ১৯২৩ সালে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-ফিফার সদস্য হিসেবে ফুটবল আঙিনায় যাত্রা শুরু হয় সেলেসাওদের। অবশ্য ১৯১৪ সাল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবলে ব্রাজিলের হাতেখড়ি শুরু হয়৷ ১৯১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ করে তারা। বুয়েন্স আইরেসে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ব্রাজিল ৩–০ গোলের ব্যবধানে হেরে যায়।
এরপর অবশ্য ব্রাজিলকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল হিসেবে আজও নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে ব্রাজিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫ বার (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ এবং ২০০২) শিরোপা জয় করেছে ব্রাজিল। এমনকি ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র দল হিসেবে সবগুলো আসরে ব্রাজিলের অংশগ্রহণ ছিল। এছাড়া কোপা আমেরিকায়ও ব্রাজিল পিছিয়ে নেই। যেখানে তারা ৯টি (১৯১৯, ১৯২২, ১৯৪৯, ১৯৮৯, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭ এবং ২০১৯) শিরোপা এবং ৪ বার ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ (১৯৯৭, ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৩) জিতেছে।
আরও পড়ুন :
» ব্রাজিলের ফুটবলে হঠাৎ অস্থিরতা! কী হচ্ছে?
» বর্তমান ব্রাজিলকে দেখলে পেলেও কষ্ট পেতেন: এডিনহো
ক্রিফোস্পোর্টস/২৯ডিসেম্বর২৩/টিএইচ/এসএ