দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্রগ্রাম টেস্ট শেষ হয়েছে মাত্র ৩ দিনেই। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ম্যাচের তৃতীয় দিনেই বাংলাদেশকে ফলোঅন করিয়ে দুই দুইবার অলআউট করেছে প্রোটিয়ারা। এক দিনেই বাংলাদেশের ১৬ টি উইকেটের পতন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা। ফলে ম্যাচটি ইনিংস ব্যবধানে জিতে ২-০ তে বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করেছে সফরকারীরা। ব্যাটারদের এমন ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে শান্ত বলেন, ‘এভাবে বাজে ব্যাটিং চলতে থাকলে এমন ফলাফল আসতে থাকবে।’
পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ করার পর আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে ছিল টিম বাংলাদেশ। এরপর গত দুই মাসে বড় দুই দলের সাথে দুইটা টেস্ট সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুটোতেই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে টিম বাংলাদেশ। ভারতে লজ্জার হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর এবার দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হতে হয়েছে ধবলধোলাই।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল নিয়ে বাংলাদেশে পা রাখেন সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা। এসময় দলের সাথে ছিলেন না নিয়মিত অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাও। কিন্তু সেই দুর্বল দলের সাথেও পেরে উঠলেন না বাংলার ছেলেরা। এদিকে প্রোটিয়াদের এই দুর্বল দলেরই তিনজন ব্যাটার কয়ারিয়ারে প্রথমবারের মতো টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন এই সিরিজে। অন্যদিকে বল হাতে রেকর্ড গড়ছেন দলটির সেরা বোলার কাগিসো রাবাদা।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুরে সিরিজের প্রথম টেস্টে ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। এরপর চট্রগ্রাম টেস্টে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করলেও এই টেস্টে আরও বাজেভাবে হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ইনিংস এবং ২৭৩ রানের বিশাল ব্যবধানে হারতে হয় টাইগারদের। টেস্ট ক্রিকেটে দুই দশক পার করা দলটি মাঠের ক্রিকেটে যেন অবুঝ বালক।
সবশেষ দুই সিরিজের চারটি টেস্ট ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে বেশকিছু কারণ পাওয়া যায়। যা বাংলাদেশকে বারবার টেস্টে ব্যর্থ করার অন্যতম কারণ।
টেস্ট ক্রিকেটের টেম্পারমেন্ট
টেস্ট ক্রিকেট হলো একটি ধৈর্যের খেলা। এধরনের ম্যাচ খেলতে ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিজে টিকে থাকা কিংবা লাইন লেন্থ ঠিক রেখে বল করে যাওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। সেশন বাই সেশন ক্রিজে টিকে থেকে যদি প্রতিপক্ষ বোলারদের মোকাবেলা করার ধৈর্য্য না থাকে তাহলে টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি সম্ভব না। অন্যদিকে দীর্ঘসময় সঠিক লেন্থে বল করতে না পারলে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের ঘায়েল করা কষ্টকর। সাধারণত বড় বড় দলগুলো এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারায় তাঁরা টেস্টে এত উন্নত।
চট্রগ্রাম টেস্ট দেখলেই বোঝা যায় বাংলাদেশ এখানে কতটা অধৈর্য। চট্রগ্রাম টেস্টে মিরাজ ৩৯ ওভার বল করেও একটা উইকেটও পাননি কিন্তু রান দিয়েছেন ১৭১। এখানেই বোঝা যায় দীর্ঘসময় সঠিক লেন্থে বল করার মতো মানসিকতা তাঁর নাই। বাংলাদেশের পেসারদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তবে পেসাররা বিদেশের মাটিতে কিছুটা সফল ছিল।
টপ অর্ডারদের ব্যাটিং ব্যর্থতা
বাংলাদেশের টপ অর্ডাররা ব্যাটিং কিভাবে করতে হয় সেটা হয়তো জানেই না। বাংলাদেশের ব্যাটিং মূলত শুরু হয় ২-৩টা উইকেট পড়ার পর। যখন মুমিনুল- মুশফিকদের মতো সিনিয়ররা এসে হাল ধরে। জাকির-সাদমান-মাহমুদুল হাসান জয়রা দলের ব্যাটিংয়ে ভরসা দিতে পারে না বরং বারবার নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে দলকে বিপদে ফেলে। কোনোরকম একটা ইনিংস ভালো খেললে আবার ৪-৫ ইনিংস তাঁদের ব্যাটিংয়ের কোনো ইমপ্যাক্টই থাকে না।
এবিষয়ে অধিনায়ক শান্ত সহজ স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে এমন হয়ে আসছে। টপ অর্ডার ভালো করতে না পারলে পরের ব্যাটারদের জন্য অতিরিক্ত প্রেশার পড়ে যায়৷ আমি জানি না তাঁরা কি চিন্তা করে ব্যাট করে। তবে এমন চলতে থাকলে ফলাফলও এমন হবে।’
ধারাবাহিকতার অভাব
মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতার প্রয়োজন হয়। আর ক্রিকেট হলো এমন একটা খেলা যেখানে ধারাবাহিকতার বিকল্প নেই। বিশ্বের বড় বড় দলগুলোর খেলোয়াড়দের মাঝে এই ধারাবাহিকতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মাঝে এই ধারাবাহিকতার ছিটেফোঁটাও লক্ষ্য করা যায় না। এক ম্যাচ ভালো খেললে পরের ১০-১২ ম্যাচে ব্যাটিংয়ে তাঁদের ভূমিকায় দেখা যায় না। যেমন সর্বশেষ চার টেস্টে মাত্র একটিতে হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছে টেস্ট ওপেনার সাদমান ইসলাম। একজন ওপেনারের যদি দলে এমন ভূমিকা থাকে তাহলে সেই দল কতটুকু সামনে এগিয়ে যাবে সেটা ধারণা করায় যায়।
এক্ষেত্রে শুধু ব্যাটাররা না বোলাররাও একই পথের পথিক। নিজেদের মতো করে পিচের সুবিধা না পেলে দুহাত ভরে রান বিলিয়ে দিতে থাকেন তাঁরা। সাবেক অধিনায়কের কথায় সত্য যে, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ অধারাবাহিকতায় ধারাবাহিক।’
অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা যখন অনভিজ্ঞ
বাংলাদেশে এখন যারা খেলছে তাঁরা অনেকেই এখন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়। সুতরাং তাঁদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাঁরা এখনও মাঠে খাবি খায়। শান্ত জাতীয় দলে চান্স পেয়েছে ২০১৭ সালে, মিরাজ ও লিটন ২০১৬ সালে, তাসকিন ২০১৪ সালে। সুতরাং তাঁদের কেউই এখন নবীন নয়। তারপরও দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ।
অধিনায়ক শান্তর সর্বশেষ ১০ টেস্ট ইনিংসের রান ২৬৯ রান। গড় ২৬.৯। অন্যদিকে সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের সবশেষ ১০ ইনিংসের রান ১৪০। গড় ১৫.৫৬। সুতরাং বলায় যায় দায়িত্ব নিতে অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাও ব্যর্থ।
পরিকল্পনায় সমস্যা
পৃথিবীর যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজন হলো পরিকল্পনার। ক্রিকেটেও তার ব্যতিক্রম না। কিন্তু এই পরিকল্পনায় সঠিকভাবে করতে পারে না বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। পিচ চিনতে না পারলে ম্যাচ জয় সম্ভব না। যেমন সবশেষ মিরপুর টেস্টে সুবিধা পেয়েছে পেসাররা অথচ বাংলাদেশ স্পিনার বেশি খেলিয়ে দলে রেখেছেন মাত্র একজন পেসারকে। আবার বোলিংয়ের ধরণ বুঝতে না পেরে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। এসবই পরিকল্পনার অভাব।
ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন কম
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে খেলাটার প্রতি ভালোবাসা ও নিবেদন কম। যার কারণে ম্যাচে অতিরিক্ত ক্যাচ মিস, বাজে ফিল্ডিং, ব্যাটিং ও বোলিংয়ে সবকিছুতেই ফুটে ওঠে। আর এধরণের নিবেদনহীন এবং ভালোবাসাহীন ভাবে খেলার ফল হলো হতাশাজনক পারফরম্যান্স। একটি দেশের জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ববোধ, খেলার প্রতি এবং দেশের প্রতি নিবেদন থাকা উচিত।
ক্রিকেট বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটা আবেগের নাম। যে দেশের মানুষ খেলাটাকে এত ভালোবাসেন সে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটাররা কেন এমন দায়িত্বহীনভাবে খেলা করে সেটা ভাবলেই কেমন যেন হতাশা কাজ করে।
আরও পড়ুন : কখনও ভাবিনি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা খেলোয়াড় হব: ঋতুপর্ণ
ক্রিফোস্পোটর্স/০১নভেম্বর২৪/এসআর