পেলের খেলায় ছিল অপার সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দান। তিনি ফুটবল মাঠের মুহূর্তগুলোকে এতটাই চিরভাস্মর করে রেখেছেন, সেগুলো আজও ফুটবল প্রেমীদের মনে গেঁথে আছে৷ খেলোয়াড়ী জীবনে ক্লান্তিহীনভাবে ৮০টি দেশে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি ম্যাচে গোল করেছেন ১ হাজার ২৮১টি। গোটা ফুটবল দুনিয়া এমন অবিশ্বাস্য চরিত্র দেখেছে খুব কমই।
পেলের খেলা প্রসঙ্গে বিখ্যাত দক্ষিণ আমেরিকান লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো তাঁর ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’ বইতে লিখেছেন, পেলে যখন ছুটে চলতেন, তিনি প্রতিপক্ষদের ফাঁক গলে এগিয়ে যেতেন, যেভাবে মাখনের পেট চিরে এগিয়ে চলে গরম ছুরি। যখন তিনি থামতেন, তাঁর পায়ের ইন্দ্রজালে প্রতিপক্ষ হয়ে যেত মোহাবিষ্ট। তিনি যখন শূন্যে লাফাতেন, দেখে মনে হতো অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন তিনি। যখন তিনি ফ্রি-কিক নিতেন, মানবদেয়াল তৈরি করা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা গোলপোস্টের দিকে মুখ করে থাকতেন, যাতে গোলটা দেখা থেকে বঞ্চিত না হন তাঁরা।
প্রায় ২২ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে তাঁর দুই পায়ের নান্দনিক ছন্দ দিয়ে দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে রাখতেন৷ মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেন৷ এমনকি পুরো ক্যারিয়ারে ব্রাজিলের হয়ে তিনটি ও নিজ ক্লাব সান্তোসের হয়ে জিতেন দুটি বিশ্ব শিরোপা৷
অথচ শতাব্দীর সেরা তো বটেই, সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবেও স্বীকৃত, পেলের কখনো খেলা হয়নি ইউরোপের মতো জমজমাট ফুটবল বাজারে৷
তাঁর সমসাময়িক দিয়েগো মারাদোনা বার্সেলোনা ও নাপোলিতে খেলেছেন। এমনকি পেলের আবির্ভাবের আগেও ইউরোপের ফুটবলে রাঙিয়েছেন আর্জেন্টিনা ও ল্যাতিন আমেরিকার আরেক কিংবদন্তী আলফ্রেদো ডি স্টেফানো।
ইউরোপের জায়ান্ট ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাসে খেলার প্রস্তাব পেয়েও পেলে কেন দেশ ছাড়েননি? তাঁর বয়স ২০ হওয়ার আগেই ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ানিও কুয়াদ্রোস পেলেকে ‘অরপ্তানীযোগ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করেন। সে কারণে প্রাথমিকভাবে তাঁর ইউরোপে খেলার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া ২০০৫ সালে ফোরফোরটু ম্যাগাজিনে পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন পেলে। সেখানে পেলের উদ্দেশ্যে পাঠকদের একটি প্রশ্ন ছিল ইউরোপে খেলতে না পারায় কোনো অনুশোচনা হয় কিনা, কোনো ক্লাবের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন কিনা?
জবাবে কিংবদন্তি পেলের উত্তর ছিল এমন, ‘ইউরোপ থেকে প্রচুর প্রস্তাব ছিল। তবে সান্তোসেই আমার ভালো লাগছিল। ওই সময়ের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য হচ্ছে, তখন এত টাকা দিত না যে প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। আমার ক্যারিয়ারের শেষ দিকে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে চমৎকার একটা প্রস্তাব এসেছিল। জুভেন্টাস থেকে জিওভানি আগনেলি আমাকে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফিয়াটের শেয়ার দিতে চেয়েছিল।’
সান্তোসের প্রেমে পেলে এতোটাই মন্ত্রমুগ্ধ ছিল যে, জীবনের আঠারটি বসন্ত তিনি এখানেই কাটিয়েছেন৷ সান্তোসের হয়ে পুরো ক্যারিয়ারে ৬৩৮ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে গোল দিয়েছেন ৬১৯টি৷ ইউরোপে খেলা না হলেও পরে অবশ্য একটি বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন পেলে।
১৯৭৫ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল ক্লাব নিউ ইয়র্ক কসমসে। ভিনদেশের ক্লাবে এসেও উজ্জ্বলতা হারাননি পেলে৷ ফুটবল নিয়ে তার পায়ে কারুকাজ দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতো তখনকার দর্শকরা৷ জীবনের প্রথম বিদেশী ক্লাব নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে ৫৬ ম্যাচে করেছিলেন ৩১টি গোল৷ মাত্র ২ বছর পরেই হাডসন নদীর এই ক্লাবের হয়ে খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসরে যান তিনি।
আর ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর পুরো পৃথিবী থেকেই অবসরে যান তাবৎ ফুটবল দুনিয়ার কিংবদন্তী এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু ওরফে পেলে৷
আরও পড়ুন: আনচেলত্তির ‘না’, ব্রাজিলের কোচ হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে কারা?
ক্রিফোস্পোর্টস/০৩জানুয়ারি২৪/টিএইচ/এমটি